Sunday, September 7, 2008

দার্জিলিং এবং ভ্রমণকাহিনী এবং...

প্রকাশ: প্রথম আলো সাময়িকি 'রস আলো', ২৬ মে, ২০০৮

দার্জিলিং এবং ভ্রমণকাহিনী এবং...
উৎপল শুভ্র


আলসে লোকের যা হয়, বেশির ভাগ কাজকেই মনে হয় বিরক্তিকর। তবে তার মধ্যেও কমবেশি থাকে। কেন যেন ব্যক্তিগত ড্রয়ারের অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র বেছে ফেলে দেওয়ার সাধারণ কাজটা আমার কাছে ‘বিরক্তিকর কাজের’ তালিকায় শীর্ষ তিনেই থাকে। কদিন আগে তা করতে গিয়েই টুকরো কাগজটা পেলাম। একটা হোটেলের বিল। এত দিন কীভাবে তা ড্রয়ারে থাকল, ভেবে একটু বিস্িনতই। কম তো নয়, এগারোটি বছর! ওই টুকরো কাগজটাই ফিরিয়ে নিয়ে গেল দার্জিলিংয়ে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ হয়ে যাওয়া টয় ট্রেন, জানালা দিয়ে হোটেলের রুমে ঢুকে যাওয়া মেঘ, পাহাড়ি রাস্তায় মেরুদন্ডে শিরশিরে অনুভুতি ছড়িয়ে দেওয়া সব বাঁক, টাইগার হিলে সুর্যোদয়... সব ছাপিয়ে যে ভ্রমণকাহিনীর শিরোনাম হওয়া উচিত−জরিমানা সফর!
১৯৯৭ সালের মে। প্রখর তপনতাপে পুড়ছে ঢাকা আর আমাকে ডাকছে দার্জিলিং। কলকাতায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ-পাকিস্তান ইনডিপেন্ডেনস কাপ ফাইনাল কভার করতে যাব ঠিক হয়ে আছে। সেটি শেষ করেই তাহলে দার্জিলিং! কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতেই যেন আগুনের হল্কা লাগল গায়ে। ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে বোধ হয় একেই বলে। কলকাতার তুলনায় ঢাকা তো দেখি নাতিশীতোষ্ণ। ম্যাচ শেষ হওয়ার পরদিনই এখান থেকে পালাতে হবে।
কলকাতায় অভিজ্ঞ বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে যে টিপস পাওয়া গেল, তাতে সবচেয়ে ভালো কলকাতা থেকে রাতের ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি, সেখানে সকালে পৌঁছে টয় ট্রেনে দার্জিলিং। কিন্তু কলকাতার গরম তো দেখছি রাত-দিন বৈষম্য করতে একদমই রাজি নয়। এই গরমে সারা রাতের জার্নি! সেই ব্যবস্থাও আছে, কিন্তু শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় স্িলপার পেতে ভাড়া গুনতে হবে তিন গুণেরও বেশি। তাতেও আপত্তি নেই, সমস্যাটা হলো টিকিট পাওয়া নিয়ে। কলকাতার বড় একটা অংশ গরমে কয়েক দিনের জন্য দার্জিলিংয়ে ‘পালায়’, এসি কামরায় ১৫-২০ দিন পরের টিকিট পাওয়াও নাকি কঠিন। কলকাতার প্রভাবশালী সাংবাদিক বন্ধু মণখানেক কাঠ ও তার চেয়েও বেশি খড় পুড়িয়ে অবশেষে উদ্ধার করল। যাক্, এবার শান্তি!
কিন্তু আমি একাই শান্তি পাব ভেবে প্রবল ঈর্ষান্বিত প্রকৃতি যাত্রার দিন কলকাতার সবার জন্যই শান্তির ব্যবস্থা করে ফেলল। সকাল থেকেই অঝোর বর্ষণ, সন্ধ্যা-সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশনে পৌঁছার সময়ও তা চলছে। গরম তো পালিয়েছেই, একটু যেন শীত-শীতও লাগছে। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আর শীত-শীত নয়, রীতিমতো কাঁপাকাঁপি অবস্থা। চারদিক থেকে এসি কমিয়ে দেওয়ার জন্য হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল। কামরার অ্যাটেনডেন্ট বিনীতভাবে জানালেন, পুরো ট্রেনের শীততাপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত, এর চেয়ে কম ‘শীত’-এর ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। শীতের চেয়ে আমাকে অবশ্য টিকিটের দামটাই বেশি বিরক্ত করতে লাগল। এসিতে যাওয়ার কী দরকার ছিল, একটু গরম লাগলেই কি মরে যেতি নাকি! অন্য অনেকে যাচ্ছে না!
যাক্, যা হওয়ার তা তো হয়েছেই। সকালে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছার পর কী করতে হবে−মনে মনে সেটির রিহার্সাল দিতে লাগলাম। সাংবাদিক বন্ধু বারবার বলে দিয়েছে, ‘ট্রেন স্টেশনে থামতেই নেমে উল্টো দিকের প্লাটফর্মের দিকে ঝেড়ে দৌড় দিবি। টয় ট্রেনে আসন নির্দিষ্ট করা নেই, একটু দেরি হলেই আর বসার জায়গা পাবি না। প্রায় আট-নয় ঘণ্টার জার্নি, জানালার কাছে বসতে না পারলে সব মাটি।’ কিন্তু টিকিট? টিকিট কাটতে হবে না! বন্ধু হেসে আশ্বস্ত করেছে, ওটা ব্যাপার নয়। টিটিকে কলকাতা টু জলপাইগুড়ির টিকিট দেখিয়ে ট্রেনেই তা কেটে নিবি। সবাই তা-ই করে।
টয় ট্রেনের জানালার পাশে একটা সিটে আরাম করে বসার পর মনে মনে ওই বন্ধুকে ধন্যবাদ দিলাম। ওর সুপরামর্শ না পেলে দাঁড়িয়েই যেতে হতো! ট্রেন স্টেশনে ঢোকার আগেই দরজার কাছে, থামতে না থামতেই নেমে উল্টো দিকের প্লাটফর্মে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দেওয়ার পরও টয় ট্রেনে উঠতে সিনেমার টিকিট লাইনের মতো অভিজ্ঞতা হয়েছে। দেখতে না দেখতেই কামরা পূর্ণ। অনেককেই দাঁড়িয়ে যেতে হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তাদের কেউ কেউ আমার দিকে এমনভাবে তাকাতে লাগল, যেন আমি অন্যায়ভাবে তাদের আসন দখল করে আছি! ঘটনা হলো, আমি যে টিকিটবিহীন যাত্রী, এটা তাঁরা জেনে গেছে।
টিটি এসে টিকিট চাইবার পর নিতান্ত অনিচ্ছায় বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে একটু বিরক্তি নিয়েই কলকাতা টু নিউ জলপাইগুড়ির টিকিটটা দেখিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলেছি, দার্জিলিং পর্যন্ত টিকিট দিন।
টিটি পকেট থেকে রিসিট বই বের করতে করতে ততোধিক গম্ভীর মুখে জানিয়েছে, ভাড়া ২৫ রুপি আর পেনাল্টি ৪৫ রুপি (অনেক দিন আগের কথা, একটু এদিক-ওদিক হতে পারে, তবে জরিমানার পরিমাণটা যে টিকিটের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ছিল তা মনে আছে)। আমি তীব্র প্রতিবাদ করলাম। এই ট্রেনে উঠেই টিকিট কাটা নিয়ম−বন্ধুকে উদ্ধৃত করে এ কথা বলতেই টিটির মুখে ব্যঙ্গের হাসি, ‘ট্রেনে ওঠার আগেই টিকিট কাটতে হয়, তাও জানেন না? কথা শুনলে মনে হয় এই দেশে থাকেন না!’
আমি বললাম, ‘আসলেই থাকি না। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি।’
‘যেখান থেকেই আসুন, কিচ্ছু আসে-যায় না। পেনাল্টি দিতেই হবে।’
কী আর করা! দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য এই তিক্ত স্নৃতির রেশটাও মুছে দিল টয় ট্রেন। ওই যাত্রাপথের বর্ণনা আর না-ই দিলাম। এ নিয়েই আলাদা একটি লেখা হতে পারে। শুধু বলি, এখনো খুব মন খারাপ হলে আমি ওই টয় ট্রেনের শরণ নিই। সবুজ পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকেবেঁকে চলছে ট্রেন, বেশির ভাগ সময় এমনই গতি যে মনে হচ্ছে নেমে হাঁটলেও এটিকে হারিয়ে দেওয়া যাবে। ওপরে ছোপ ছোপ সাদা মেঘ বুকে নিয়ে ঝকঝকে নীল আকাশ, নিচে পাহাড়ে জমে থাকা সাদা মেঘ... জানালার পাশে বসে এসব দৃশ্য দেখা। আহা। জীবন কত সুন্দর!
কার্শিয়াং আসতে আসতে তা আর সুন্দর থাকল না। স্টেশনে ট্রেন থেমেছে আর নড়ার নাম নেই। কী ব্যাপার? ব্যাপার গুরুতর। কয়লা পুড়িয়ে চলা মান্ধাতা আমলের ইঞ্জিনে কী একটা গন্ডগোল হয়েছে, কখন ঠিক হবে বা আদৌ হবে কি না, কেউ বলতে পারছে না। অনেকেই ট্রেন থেকে বামাল নামতে শুরু করেছে। ট্রেনের ভরসায় বসে থেকে লাভ নেই। দার্জিলিং খুব দুর নয়, বাসে চলে যাওয়াই ভালো। আমিও তাদের অনুগামী হলাম। শুরুর রোমাঞ্চ মুছে দিয়ে টয় ট্রেন অনেকক্ষণই ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছিল। বাসই ভালো। তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। ট্রেনে জানালার পাশের সিটের বদলে লਆড়-ঝਆড় বাসে গাদাগাদি ভিড়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সময় অবশ্য আর সেটিকে ভালো মনে হলো না। পাশে দাঁড়ানো এক লোকের গা থেকে ঘামের তীব্র দুর্গন্ধ আসছে। একটু পরপর শরীরের ভার এক পা থেকে আরেক পায়ে চাপানোর সময় নিয়ম করে আমার পায়ে পাড়া দিয়ে যাচ্ছেন। আমার আহ্-উহ্ শুনে উল্টো বিরক্ত হয়ে তাকাচ্ছেন−আহ্, মোলো! তোর পাটা সরাবি না?
সবকিছুই একসময় শেষ হয়। এই নরকযাত্রাও হলো। প্রথমবারের মতো দার্জিলিং−বাস থেকে নেমে কৌতুহল ভরে চারদিকে তাকাচ্ছি। হঠাৎই হাতের ব্যাগে টান পড়ল। তাকিয়ে দেখি তিন-চারজন তরুণ এটির মালিকানার দাবিদার হয়ে আবির্ভুত। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ ধরেই খিদেয় পেট জ্বলছিল, ভ্যাবাচেকা খাওয়ায় তা নেভার কথা নয়। আসল ঘটনা বুঝতে অবশ্য বেশিক্ষণ লাগল না। ব্যাগের প্রতি ওদের লোভ নেই। ওরা সবাই খুব পরোপকারী। আমাকে ন্যায্য দামে ভালো হোটেলে পৌঁছে দিতে ব্যাকুল!
হোটেল-টোটেল ঠিক করা নেই জেনে ওদের উৎসাহ আরও বাড়ল। আমার উপকার করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় তুমুল ঝগড়াঝাঁটিও শুরু হয়ে গেল। মাথায় খাড়া খাড়া চুল, খ্যাংড়াকাটি চেহারার তরুণটি অবলীলায় দাবি করে বসল, স্যার (মানে আমি) এ বাসেই আসছেন জেনে এক ঘণ্টা ধরে ও আমার পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার ওপর ওর অধিকারই তাই সবচেয়ে বেশি। এমন জোর দিয়ে বলা যে, আমারও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল। ওর কল্পনাশক্তিতে মুগ্ধ হয়ে ওকেই বেছে নিলাম। পরিচয়-টরিচয়ও হলো। নাম অসিত। পেশা তো আগেই বুঝতে পেরেছি−হোটেলের দালাল। ৪০০ রুপির এক হোটেলে তুলে দেওয়ার পর ২০ রুপি বখশিশ পেয়ে দারুণ খুশি। ওর কারণে ৬০০ টাকার হোটেল ৪০০ টাকায় পেলাম−বিদায় নেওয়ার আগে বারবার এটি মনে করিয়ে দেওয়াটাকে অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করল ও। সস্তায় হোটেল পেয়ে আমিও খুব খুশি।
নিজের রুমে ঢুকছি, উল্টো দিকের রুমে তালা দিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকা দুই বাঙালি তরুণ ‘হাই’ বলে জিজ্ঞেস করল, কত টাকায় উঠলেন?
আমি বিজয়ীর হাসি দিয়ে বললাম−‘৪০০ টাকা! একটা ছেলে ব্যবস্থা করে দিল।’
‘বলেন কী? আমরা তো ৩০০ টাকায় ডাবল রুমে উঠলাম। এসব হোটেলে মুলোমুলি করতে হয়।’
হোটেলে চেক-ইন করার সময়ই আমাকে একা দেখে ‘সন্দেহজনক’বোধক ভঙ্গিতে তাকিয়েছে রিসেপশনে বসা তরুণ। পরের দুইদিন এই দৃষ্টিটা একরকম অভ্যাসই হয়ে গেল। সবাই হয় ফ্যামিলি, নয় বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে, দার্জিলিং আমার মতো এমন নিঃসঙ্গ পর্যটক খুব একটা দেখেনি। পরের তিন দিন কী কী হলো, তার সবিস্তার বর্ণনা আর নাই-বা দিলাম। অর্থদন্ডের আর দুটি ঘটনা শুধু বলি। পরদিন সকালে হোটেলের রিসেপশনে নামতেই দার্জিলিংয়ের অবশ্য-দ্রষ্টব্য আকর্ষণগুলোর একটা তালিকা হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো। সাংবাদিকতা আর ব্যাচেলর জীবনের যৌথ প্রভাবে সেই সময় প্রায় ভোরে ঘুমিয়ে প্রায় দুপুরে ওঠার অভ্যাস। সকালের সব কর্মসুচি তাই বিষবৎ পরিত্যাজ্য বলে বিবেচিত। বেলা তিনটায় ‘সেভেন পয়েন্ট’ না কি যেন, এটায় যাওয়া যায়।
দুপুর ১২টার দিকে দার্জিলিংয়ের প্রাণকেন্দ্র ম্যালে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। ম্যাল থেকে চারদিকে পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা। তারই একটা ধরে হাঁটতে এমন ভালো লাগছিল যে, হাঁটতে হাঁটতে অনেক দুর চলে গেলাম। রাস্তার পাশে ঢালের ওপর বেঞ্চ। তারই একটাতে বসে দুরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে তখন চলমান হূদয়ঘটিত জটিলতা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে ভাবতে ভাবতে সেভেন পয়েন্ট পরিদর্শনে যাওয়ার উৎসাহটা আর থাকল না। ওখানে বসেই বিকেল করে ফেলার পর হোটেলে ফিরতেই রিসেপশনের তরুণের কন্ঠে অনুযোগ, ‘আপনার না সেভেন পয়েন্টে যাওয়ার কথা ছিল!’ আমি তো মুগ্ধ। এরা বোর্ডারের প্রতি কত মনোযোগী, কিছুই ভোলে না। আমি যেতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করলাম। সত্যিকার ‘দুঃখটা’ অবশ্য পেলাম একটু পর, যখন ওই তরুণ জানাল, আমার হোটেল বিলের সঙ্গে সেভেন পয়েন্ট পরিদর্শনের ৫০ রুপি যোগ হবে! না গিয়েও টাকা দিতে হবে−এ কেমন কথা? আপনি না যাওয়ায় জিপের একটা সিট খালি গেছে, সেই ক্ষতিপূরণ কে দেবে−এই যুক্তিতে উড়ে গেল আমার প্রতিবাদ।
একের পর এক এমন ‘আর্থিক বিপর্যয়ে’ পরের দিনটা একটু থম মেরে রইলাম। ঘুম থেকে উঠতে উঠতেই দুপুর, ম্যালে ঘোরাঘুরি করেই কাটিয়ে দিলাম বিকেল-সন্ধ্যা। কিন্তু দার্জিলিংয়ে এসে টাইগার হিলে সুর্যোদয় না দেখে গেলে কেমন হয়! ম্যালেতে অনেককে বলাবলি করতে শুনছিলাম, দু-তিন দিন আবহাওয়া খুব ভালো যাচ্ছে, ভোরে কুয়াশা-টুয়াশা থাকছে না বলে সুর্যোদয়টা নাকি দারুণ দেখা যাচ্ছে। আমিও দেখব বলে মন স্িথর করে ফেললাম। ভোরে ওখানে পৌঁছাতে হলে শেষ রাতে উঠতে হবে−না ঘুমালেই হবে। হোটেলের লোকজন যখন ডাকাডাকি শুরু করল, আমি তখন জেগেই। টাইগার হিলে যাওয়ার জিপে উঠে দেখি, বাকি সবারও আমার মতোই বেশ। সোয়েটার-চাদর-মাফলারে চোখ দুটি ছাড়া প্রায় আর সবই ঢাকা। অন্ধকারের মধ্যে শুধু হেডলাইটের আলোয় ভয়ঙ্কর সব বাঁকের রাস্তা পেরিয়ে টাইগার হিলে পৌঁছানোর পর ড্রাইভারের সহকারী বারবার মনে করিয়ে দিল, জিপের নম্বরটা ভুলবেন না। ভুললে সার বেঁধে দাঁড়ানো অসংখ্য জিপ-গাড়ি-মাইক্রোবাসের মধ্যে আর নিজেদের জিপ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আরে, এতবার বলার কী আছে? এটা মনে না থাকার কী হলো? হেলাফেলায় একবার জিপের নম্বর প্লেটটা দেখে যে সুর্যোদয়ের এত গল্প শুনেছি তা দেখার রোমাঞ্চে জোরে পা চালালাম। কিন্তু কোথায় সুর্যোদয়? ঘন কুয়াশায় দুই হাত দুরের মানুষও অস্পষ্ট, সুয্যি মামাকে কীভাবে দেখব? তার পরও বাকি সবার মতো আমিও আমার বিপরীতে আশা করে দুর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছি। মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছি, সুর্যোদয় না-ই দেখতে পেলাম, প্রাণ ভরে এমন কুয়াশা দেখার সুযোগটাই ছাড়ি কেন! সমস্যা একটাই, সোয়েটার-মাফলার ভেদ করে ঠান্ডাটা হাড়ে ঢুকে যাচ্ছে। একটু চা-কফি হলে হতো।
টেলিপ্যাথি-হোমিওপ্যাথি-অ্যালোপ্যাথি কী বলবেন তা আপনার ব্যাপার, তবে সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কানের পাশ থেকে ‘কফি-কফি’ চিৎকার। ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের কাপে কফি, সেটির দাম ১০ রুপি! ঠিক আছে, খাই এক কাপ! পাহাড়ের এত ওপরে, দাম তো একটু বাড়বেই। কফি খেয়ে দাম দিয়েছি, কিশোর বিক্রেতার প্রশ্ন: আউর দো?
‘আউর দো’ মানে! আমি তো একটা কফিই খেলাম। ‘নেহি, নেহি, আপ কা সাথ আউর দো আদমি থা।’
এমনিতেই সেভাবে হিন্দি বলতে পারি না, বিস্িনত হয়ে আরও গুলিয়ে ফেললাম, ‘না না, হাম তো একলাই থা।’
ওই ছেলে নাছোড়, আমার সঙ্গে আরও দুজন ছিল। আমি দাম দেব ভেবেই ও তিন কাপ কফি দিয়েছে। গলা একটু চড়িয়েই এবার বলল, ‘সাফ সাফ রুপিয়া ডালো।’
আশপাশের লোকজন খুবই সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি তাই তিন কাপের দামে এক কাপ কফি খাওয়ার ব্যাপারটি চুড়ান্ত করলাম।
সুর্যোদয় দেখতে পেলে দুঃখটা হয়তো ভুলে যাওয়া যেত। সেটি যে দেখা যাবে না, তা বুঝতে পেরে আস্তে আস্তে সবাই জিপে ফিরে যেতে শুরু করেছে। আমিও ‘ভগ্ন মনোরথ’ কথাটার পুরো মর্মার্থ উপলব্ধি করতে করতে নিজের জিপের দিকে ফিরছি। নিজের জিপ? নম্বরটা যেন কত? এই যা, কিছুতেই মনে করতে পারছি না। একের পর এক জিপ চলে যাচ্ছে আর আমি চড়াই-উতরাই রাস্তা দিয়ে উঠছি আর নামছি। রীতিমতো ভয় লাগছে, শেষ পর্যন্ত খুঁজে না পেলে কী হবে? কমতে কমতে আর একটা জিপই আছে, আমিও ‘যা আছে কপালে। হয়তো এটাই হবে’ ভেবে তাতে উঠে বসে রইলাম। একটু পরই দেখলাম এক বৃদ্ধের নেতৃত্বে কলকল-খলখল করতে থাকা তরুণ-তরুণী-কিশোরদের একটা দল এই জিপের দিকেই এগিয়ে আসছে। ভোরে প্রায়ান্ধকারে সোয়েটার-মাফলারে মোড়া সফরসঙ্গীদের কারও চেহারাই দেখতে পারিনি, তবে তাদের মধ্যে দু-তিনজন তরুণী থাকলেও চিনতে পারব না, চোখ এতটা খারাপ হয়নি। তার মানে এই দলটা আমার জিপে ছিল না, আমি ভুল জিপে বসে আছি। আমার দিকে কেমন যেন তাকিয়ে ওই দলটা জিপে উঠে বসার পর ড্রাইভারের সহকারী ‘এক, দো, তিন...’ গুনতে শুরু করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল−আপ? আপ কৌন?
‘হাম? হাম হাম হ্যায়!’
এমন অদ্ভুত উত্তর শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে যাওয়ায় আমি একটুও অবাক হলাম না। নার্ভাস হয়ে এটা কী বলে ফেললাম ভেবে আমিই তো হতভম্ব!
যারা জিপে উঠেছে, তারা যে বাঙালি নয়, কথাবার্তাতেই তা বুঝেছি। বিপদ বুঝে জিপের বৈধ আরোহী দলটির ওই তরুণকে ইংরেজিতে ঘটনা খুলে বলার পর ‘ঠিক আছে, কোনো ব্যাপার নয়’ শুনে আমি স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললাম (আচ্ছা, স্বস্তির নিঃশ্বাসটা কীভাবে ফেলে? সেটি কি আলাদা কিছু হয়? তাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেশি থাকে? সুকুমার রায় ‘মাথায় কত প্রশ্ন আসে’ ছড়াটা কি আর এমনি লিখেছিলেন!)। এই জিপটাতে যেতে না পারলে ওই পাহাড়চুড়ায় পড়ে থাকতে হতো। সুর্যোদয়-সুর্যাস্ত ছাড়া ওখানে জনমনিষ্যির পা পড়ে বলে তো মনে হয় না। বাবা-ভাই-বোন মিলে ছুটি কাটাতে আসা এই পরিবারটি কথায় কথায় হাসিতে ভেঙে পড়ছে। ওরা যখন হাসছে, আমিও ভদ্রতা করে হাসছি। কিছুক্ষণ পর মাথায় লাল স্কার্ফ বাঁধা তরুণী একটু যেন অবাক হয়েই আমাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি আমাদের কথা বুঝতে পারছেন?’
আমি বললাম, ‘বুঝব না কেন? আমি হিন্দি ভালো বলতে না পারলেও বুঝতে পারি।’
‘আরে, আমরা তো হিন্দি বলছি না। আমরা বলছি মারাঠি।’
মেয়েটির হাসির সঙ্গে বাকিরাও যোগ দিল। আমিও এতক্ষণে বুঝলাম, কেন ওদের কথাগুলো ঠিক হিন্দি নয়, হিন্দি-হিন্দি লাগছিল। আমি হিন্দিই ধরে নিয়ে একই ভাষা অঞ্চলভেদে কতভাবেই না উচ্চারিত হয়−এ নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনাও করেছি। না হাসলেই চলত, কিন্তু এমন উপকারের পর ওদের আনন্দে নিজের আনন্দিত না হওয়াটাকে অভদ্রতা ভেবেই অমন হাসছিলাম। বাকি রাস্তায় ওদের তুমুল হাস্যরোলের সময়ও আমি মুখ মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর করে রাখলাম।
টাইগার হিল থেকে ফেরার পথে কয়েকবার যাত্রাবিরতি আছে। অনেক পুরোনো একটা বৌদ্ধমন্দিরে থামে জিপ, আরেকটা কী যেন জায়গায় দুরবিন দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার ব্যবস্থা। বৌদ্ধমন্দিরে নামার পরই বুঝলাম, জিপ-ড্রাইভারের সহকারী সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। আমাকে একা পেয়েই দাবি করল, ওকে ‘ওয়ান ওয়ে’ টিকিটের টাকা দিতে হবে। তখন হ্যাঁ-না কিছু না বলে এড়িয়ে গেলেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার উত্তেজনায় বাকি সবাই আমাকে ফেলে এগিয়ে যেতেই ওই সহকারী রীতিমতো চেপে ধরল−টাকা দিতেই হবে! দার্জিলিং যাত্রার শুরু থেকে জরিমানা দিতে দিতে বিপর্যস্ত আমার মন এবার বিদ্রোহী হয়ে উঠল। এমন করিয়া জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল? না, আমি আর জরিমানা দেব না। ছেলেমানুষের মতো জিপের বৈধ আরোহী দলের ওই তরুণকে ডেকে বললাম, ‘দেখো, ও আমার কাছে টাকা চাইছে।’ আচ্ছা একটা ধমক দিয়ে ওই তরুণ বলল, ‘আমরা তো তোমার পুরো জিপই ভাড়া করেছি। উনার কাছ থেকে টাকা চাইছ কেন?’
আমি বিজয়ীর হাসি হাসলাম। আমার কাছ থেকে বাড়তি টাকা খসানো এত সহজ নয়!