Monday, July 28, 2008

ভূমিকম্প হলে কী করণীয়/জীবন রক্ষার টিপস

প্রকাশঃ সচলায়তন

ভূমিকম্প হলে কী করণীয়/জীবন রক্ষার টিপস

তানভীর ইসলাম
যুক্তরাস্ট্র প্রবাসী, পেশায় নগর পরিকল্পনাবিদ/গবেষক/শিক্ষক। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও টেকসই নগর উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছেন


বাংলাদেশে বিশেষত ঢাকা শহরে বড় কোন ভূমিকম্প হলে পরিস্থিতি কী হবে, সেটা চিন্তা করতেও ভয় লাগে। আমি সাধারণত ‘আবহাওয়াজনিত’ দুর্যোগ নিয়ে কাজ করি। তাই, ভূমিকম্প আমার বিষয় নয়। কিন্তু যেহেতু সবরকম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মধ্যেই মিল রয়েছে, কাজেই এর কিছু খোঁজ আমাকেও মাঝে মাঝে রাখতে হয়। নীচে ভূমিকম্পের সময় জান বাঁচানোর জন্য কী করণীয় সে সম্পর্কে কিছু টিপস দিলাম। টিপসগুলো বিভিন্ন ভূমিকম্পের সময় উদ্ধার কর্মীদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা।

১। ভূমিকম্পের সময় অনেকে টেবিল, চেয়ার, বিছানা ইত্যাদির নীচে আশ্রয় নেন- যা অবশ্যই পরিহার করা উচিত। কিন্ত কিছুদিন আগেও এটা ভূমিকম্পের সময় বহুল প্রচলিত একটি পদ্ধতি ছিল, যা ‘ডাক এন্ড কাভার’ (Duck and Cover) পদ্ধতি নামে পরিচিত। পৃথিবীর বড় বড় ভূমিকম্পে উদ্ধারকর্মী হিসেবে যারা কাজ করেছেন তারা বলছেন- ভূমিকম্পের সময় ‘ডাক এন্ড কাভার’ পদ্ধতি যারা অনুসরণ করেছে, তাদের বেশিরভাগকেই তারা নিহত অবস্থায় পেয়েছে। ডাগ কপ নামক একজন অভিজ্ঞ উদ্ধারকর্মী ১৯৮৫ সালে মেক্সিকো সিটির ভূমিকম্পে উদ্ধার কাজে অংশ নেন। প্রথম যে বিল্ডিংটিতে তিনি ঢোকেন, সেটি ছিল একটি স্কুল। ভূমিকম্পের সময় স্কুলের বাচ্চাদের বলা হয়েছিল ডেস্কের নীচে আশ্রয় নেবার জন্য। তারা প্রতিটি শিশুকেই ডেস্কের নীচে গুঁড়িয়ে যাওয়া অবস্থায় পান। এক্ষেত্রে ভূমিকম্পের সময় যেটা হয়- বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ার সময় সিলিং-এর সম্পূর্ণ ভার এসব অবজেক্টের ওপর পড়ে, তাতে এর নীচে আশ্রয়গ্রহণকারীর বেঁচে থাকার কোন উপায় থাকে না। তাই, ভূমিকম্পের সময় ডেস্ক, টেবিল ইত্যাদি কোন কিছুর নীচে ঢুকে আশ্রয় নেয়া ঠিক না।

২। উদ্ধার কর্মীরা আরো লক্ষ্য করেছেন- বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ার সময় সিলিং যখন কোন অবজেক্টের ওপর পড়ে একে গুঁড়িয়ে দেয়, ঠিক তার পাশেই ছোট্ট একটি খালি জায়গা বা void-এর সৃষ্টি হয়। একে তারা বলছেন ‘সেফটি জোন’ বা ‘ট্রায়াঙ্গল অফ লাইফ’। তাই ভূমিকম্পের সময় বড় কোন সোফা বা বড় কোন অবজেক্ট যেটা কম কম্প্রেস করবে- এরকম কিছুর পাশে আশ্রয় নিলে বাঁচার সম্ভাবনা বেশি থাকে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ছোট্ট একটু void-ই যথেষ্ট। বিপন্ন অবস্থায় কুকুর, বিড়াল এবং শিশুদের একটা সহজাত প্রবৃত্তি হল কুন্ডলি করে গুটিশুটি হয়ে যাওয়া। ভূমিকম্পের সময় মানুষেরও এটা অনুসরণ করা উচিত। তাহলে বিভিন্ন অবজেক্টের পাশে গুটিশুটি করে আশ্রয় নিলে এগুলো ভূমিকম্পের সময় যে ছোট void-এর সৃষ্টি করবে তাতে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকবে।

৩। রাতের বেলা ঘুমানোর সময় ভুমিকম্প হলে কোন হুড়াহুড়ি করার দরকার নেই। গড়িয়ে মেঝেতে কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়ুন বিছানাকে ঢাল বানিয়ে। তার মানে আবার বিছানার নীচে যেন ঢুকবেন না, বিছানার পাশে আশ্রয় নিন। তেমনি ভূমিকম্পের সময় জানালা বা বারান্দা দিয়ে লাফ দেয়া এসবও করবেন না (আজকের পত্রিকায় দেখলাম অনেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছে)। সোজা কোন সোফা বা দুই নাম্বার পয়েন্টে যেভাবে বলেছি সেভাবে ঘরের মধ্যেই কোন অবজেক্টের পাশে আশ্রয় নিন।

৪। অনেককে বলতে শুনেছি ভূমিকম্পের সময় দরজার নীচে আশ্রয় নিলে নাকি বাঁচার সম্ভাবনা বেশি থাকে! দরজার নীচে বা পাশে থাকলে নির্ঘাত মারা পড়বেন। যদি দরজার নীচে থাকেন তবে সিলিং-এর নীচে চাপা পড়ে মারা পড়বেন আর যদি পাশে থাকেন দরজা আপনাকে দু’ভাগ করে কেটে ভেঙ্গে পড়বে।

৫। ভূমিকম্পের সময় কখনই সিঁড়িতে আশ্রয় নেবেন না। সিঁড়ির ‘মোমেন্ট অফ ফ্রিকোয়েন্সী’ বিল্ডিং-এর চাইতে ভিন্ন হয় এবং অনেক সময় বিল্ডিং ভেঙ্গে না পড়লেও সিঁড়ি দ্রুত ভেঙ্গে পড়ে।

৬। চেষ্টা করুন বাসার একেবারে ভিতরের দিকের রুমে না থেকে বাইরের ওয়ালের কাছাকাছি আশ্রয় নিতে। বিল্ডিং-এর ভেতরের দিকে থাকলে সবকিছু ভেঙ্গে পড়ার পর আপনার ‘escape route’ বা ‘উদ্ধার পাবার রাস্তা’ ব্লক হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। বাইরের ওয়ালের কাছাকাছি থাকলে ব্লক কম থাকবে, তাড়াতাড়ি উদ্ধার পাবার সম্ভাবনাও বেশি থাকবে।

৭। ভূমিকম্পের সময় যদি গাড়ীতে থাকেন, তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির পাশে বসে বা শুয়ে পড়ুন। গাড়ীর ভেতরে থাকলে রাস্তার ওপরের বিভিন্ন অবজেক্ট (আর যদি উপরে ব্রিজ বা ফ্লাইওভার থাকে তো কথাই নেই) গাড়ীর ওপর পড়ে গাড়ীকে চূর্ণ করার ফলে মারা যাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

৮। যারা পত্রিকা অফিসে কাজ করেন তাদের জন্য সুসংবাদ। উদ্ধারকর্মী যাদের পত্রিকা অফিসে উদ্ধার কাজের অভিজ্ঞতা আছে, তারা বলেছেন- পত্রিকা অফিস বা যেসব অফিসে বড় বড় কাগজের স্তুপ আছে, সেগুলো কখনো কম্প্যাক্ট করে না। কাজেই এসব কাগজের স্তুপের পাশে তারা বড় বড় void খুঁজে পেয়েছেন। যারা এসব অফিসে কাজ করেন, তারা নিশ্চিন্তে কাগজের টালের পাশে আশ্রয় নিন।

৯। সব বড় ভূমিকম্পের পরপরই আরেকটা ছোট ভূমিকম্প হয় যেটাকে ‘আফটার শক’ বলে। এটার জন্যও সতর্ক থাকুন, না হলে পচা শামুকেই শেষমেষ পা কাটতে হতে পারে।

১০। প্রথম ভূমিকম্পের পর ইউটিলিটি লাইনগুলো (গ্যাস, বিদ্যুত ইত্যাদি) একনজর দেখে নিন। কোথাও কোন লিক বা ড্যামেজ দেখলে মেইন সুইচ বন্ধ করে দিন।

সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিঃ বাংলাদেশ যদি তলিয়ে যায়...

প্রকাশঃ প্রথম আলো, ১১ই এপ্রিল, ২০০৮; সম্পাদকীয় পাতায়

খোলা চোখে
বাংলাদেশ যদি তলিয়ে যায়...
হাসান ফেরদৌস

আফসান চৌধুরী নির্মিত একটি তথ্যচিত্রের নাম ‘ডাজ এনিবডি কেয়ার ইফ বাংলাদেশ ড্রাউনস?’ যাঁরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন, ইউটিউব ওয়েবসাইটে ছবিটি দেখতে তাঁদের পরামর্শ দেব। ভু-উপরিভাগের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বা সি-লেভেল বেড়ে যাবে, তার ফলে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকুলবর্তী ও নিচু বিস্তীর্ণ অঞ্চল আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তথ্যচিত্রটি এই সমস্যাকে ঘিরে। আফসানের কথামতো, বাংলাদেশের জন্য ভুভাগে তাপমাত্রা বৃদ্ধি কোনো তাত্ত্বিক ব্যাপার নয়। এ নিয়ে ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’ বলার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকুলবর্তী কোনো কোনো এলাকা ইতিমধ্যে তলিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। সমুদ্র এখন অনেক কাছে চলে এসেছে। প্লাবিত এলাকা ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ দল বেঁধে ঘর ছাড়তে শুরু করেছে। সরেজমিন তদন্ত শেষে আফসানের প্রশ্ন, যদি বাংলাদেশ সত্যি সত্যি ডুবে যায়, তাতে পৃথিবীর কার কী এসে যায়?
পৃথিবীর কী এসে যায় জানি না, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এ যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনিতেই আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। শহরগুলোতে পা রাখার জায়গা নেই, মানব বসতি বেড়ে যাওয়ায় কৃষিক্ষেত্রের পরিমাণও কমে আসছে। এর ওপর যদি আমরা আরও কৃষিভুমি হারিয়ে ফেলি, তাহলে সমস্যা কী রকম জটিল হবে, তা বোঝা কঠিন নয়। আমাদের দেশ কতটা ঘনবসতিপূর্ণ তা আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায়। আমেরিকার মোট জনসংখ্যা ৩০ কোটি, কিন্তু তার আয়তন ৯৮ লাখ ৩০ হাজার (৯.৮৩ মিলিয়ন) বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে বাংলাদেশের আয়তন মোটে ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার, কিন্তু তার জনসংখ্যা আমেরিকার ঠিক অর্ধেক। আয়তনের দিক দিয়ে আমাদের দেশ আমেরিকার অঙ্গরাজ্য আইওয়ার কাছাকাছি, কিন্তু সে রাজ্যের জনসংখ্যা মোটে তিরিশ লাখ। মার্কিন সাংবাদিক মার্ক হার্টসগার্ড গত বছর বাংলাদেশের ব্রਜ਼পুত্রের পাড়ে অন্তরপাড়া নামের এক গ্রাম ঘুরে এসে নেশন পত্রিকায় লিখেছেন, এখানে কবর দেওয়ার জায়গা পর্যন্ত নেই। এই গ্রামে কয়েক বছর আগেও ২৩৯টি পরিবারের বসতি ছিল। এখন তাদের সংখ্যা কমে ৩৮-এ দাঁড়িয়েছে। প্লাবন যদি স্থায়ী ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, তখন ঘরবাড়ি হারিয়ে এখানকার মানুষ যাবে কোথায়? কী খাবে?
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মতো দেশের সমস্যা নিয়ে এখন মস্ত সব গবেষণাপত্র লেখা হচ্ছে, পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন। ভিন্ন মতাবলম্বী যে নেই তা নয়, কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ পরিবেশবিজ্ঞানী এ ব্যাপারে একমত যে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা বাস্তব সত্য, কোনো কল্পকাহিনী নয়। পরিবেশে কার্বন গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মেরু অঞ্চলের জমাট বাঁধা বরফ গলতে শুরু করেছে। এর ফলে একদিকে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশগত বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। তাপমাত্রার এই বৃদ্ধি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে সমুদ্র-নিকটবর্তী নিচু অঞ্চল ভেসে যেতে বাধ্য। বিজ্ঞানীরা আগামী এক শতকের ভেতর যে পরিবর্তন হবে, তার তিনটি সম্ভাব্য চিত্র বা সিনারিওর কথা বলেছেন। পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, তাহলে সমুদ্রপিঠ .২৩ মিটার বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু তাপমাত্রা যদি ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায়, তাহলে সমুদ্রপিঠ ০.৫২ মিটার বেড়ে যাবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আমাদের চলতি জীবনযাত্রা যদি অপরিবর্তিত থাকে, জ্বালানি তেলের কোনো বিকল্প ব্যবহার আমরা উদ্ভাবনে ব্যর্থ হই, তাহলে পৃথিবীর ভুভাগের তাপমাত্রা আরও মারাত্মক পরিমাণে বেড়ে যেতে পারে। যদি এই তাপমাত্রা ৫.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায়, তাহলে আগামী ১০০ বছরে সমুদ্রপিঠ দুই মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। যদি প্রথম চিত্রটি বাস্তবে পরিণত হয়, তাহলেও বাংলাদেশের ১০০০ বর্গকিলোমিটার কৃষিজমি বিনষ্ট হবে এবং প্রায় এক কোটি মানুষ বসতবাটি হারাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুধু যে বসতবাটি তলিয়ে যাবে তাই নয়, তলিয়ে যাবে আবাদি জমি, মাছের খামার। আমরা হারাব বনাঞ্চল, হারাব মূল্যবান প্রবাল-প্রাচীর বা কোরাল রিফ। পরিবেশের ভারসাম্য বদলের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাবে, বর্ষাকাল হ্রস্ব হবে, গ্রীষ্ক্নকাল দীর্ঘ হবে। ফলে মরুপ্রবণতা বাড়বে, পদ্মা ও ব্রਜ਼পুত্র শুকিয়ে মৌসুমি নদীতে পরিণত হবে। এ ছাড়া সুপেয় পানির সংকট চুড়ান্ত আকার ধারণ করবে, নানা রকম রোগশোক মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়বে এবং শিশুমৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
সমুদ্রসীমা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে প্লাবনের যে সমস্যা তাতে কেবল বাংলাদেশ নয়, সমুদ্র উপকুলবর্তী অধিকাংশ দেশই আক্রান্ত হবে। যুক্তরাজ্য, হল্যান্ড বা আমেরিকার লুইজিয়ানাও তলিয়ে যেতে পারে যদি কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়। ব্যবস্থা নেওয়া মানে সমুদ্র শাসন, বানের জল আটকানোর জন্য বাঁধ নির্মাণ। এর জন্য দেদার পয়সা লাগে, হল্যান্ড বা আমেরিকার সে পয়সা আছে। যুক্তরাজ্য ও হল্যান্ড বছরে এই খাতে নিজ নিজ দেশের জন্য এক একশ কোটি ডলার খরচের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের অত পয়সা কোথায়?
আবহাওয়ামন্ডলের উষ্ণতা বাড়ার যে সমস্যা, তার সৃষ্টির পেছনে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কার্যত কোনো ভুমিকাই নেই। যে ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’কে উষ্ণতা সৃষ্টির জন্য দায়ী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, বাংলাদেশে তার ব্যবহার বিশ্বের মোট ব্যবহারের ০.১ শতাংশেরও কম। অন্যদিকে আমেরিকা একাই দায়ী এর প্রায় এক-তৃতীয়াংশের জন্য। যদি শুধু কার্বন-ডাইঅক্সাইডের কথা ধরি, তাহলে একজন আমেরিকান এই গ্যাস যে পরিমাণ ব্যবহার করে, তা ১০৭ জন বাংলাদেশির ব্যবহারের সমান। শুধু আমেরিকা কেন, পশ্চিমা বিশ্বের সব দেশই জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করেই তাদের অর্থনীতি এ পর্যায়ে এনেছে। আমরা যখন সবেমাত্র শিল্পোন্নতির পথে আগুয়ান হচ্ছি, তখনই জানানো হলো, এই পথে চললে সবার আগে ডুবব আমরাই। উন্নত দেশগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তবে সে ক্ষতি সামলানোর জন্য যে অর্থ ও প্রযুক্তি দরকার, সেটা তাদের আছে। অন্যদিকে আমরা কেবল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তই নই, সে বিপদ সামলানোর মতো বিত্তও আমাদের নেই। তৃতীয় বিশ্বের কোনো কোনো দেশ তাই যুক্তি দেখাচ্ছে, যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী পশ্চিমা বিশ্ব, তার ফলাফলের দায়ভারও তাদেরই বহন করতে হবে। একদিকে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে এই বিপর্যয় মোকাবিলায় অর্থ ও প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করতে হবে।
আমরা দাবি করলাম আর আমেরিকা-জার্মানি-জাপান তাদের চেক বই নিয়ে লিখতে বসে গেল, এমন কথা ভাবা বাতুলতা। আমেরিকার বুশ প্রশাসন এখন পর্যন্ত ভুমন্ডলের উষ্ণতার বিষয়টি মানতে পর্যন্ত রাজি নয়। কার্বন গ্যাস নিয়ন্ত্রণের যে মাত্রা বেঁধে দেওয়ার কথা জাতিসংঘ বলে আসছে, তা মানতেও সে রাজি নয়। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কার্বন গ্যাস নিয়ন্ত্রণের যে চুক্তি হয়েছে তাতে উন্নয়নশীল দেশসমূহকে সাহায্যের জন্য একটি তহবিল সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে বটে, তবে তাতে চাঁদা পড়েছে খুবই সামান্য।

তাহলে পথ কী?
আমরা জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রধান প্রতিক্রিয়া হবে মানবগোষ্ঠীর স্থানান্তর। প্লাবিত অঞ্চলের মানুষ বসতবাটি ছেড়ে আশ্রয়ের সন্ধানে পথে নামবে। কিন্তু কোথায় যাবে তারা? আফসানের তথ্যচিত্রে এই প্রশ্নের একটি সোজাসাপটা উত্তর রয়েছে: এই ‘পরিবেশ-উদ্বাস্তু’রা নিজের দেশে জায়গা না পেলে পা বাড়াবে প্রতিবেশী দেশে অর্থাৎ ভারতে। এমন ঘটনা শুধু এই অঞ্চলে নয়, প্লাবন-আক্রান্ত সব দেশেই ঘটবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী ৫০ বছরে কম করে হলেও ১০০ কোটি মানুষ নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজে নিতে বাধ্য হবে। দারিদ্র্য, মরুকরণপ্রবণতা ও প্লাবণের কারণে দরিদ্র দেশগুলোর মানুষ বরাবরই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আশ্রয় খোঁজে। কিন্তু ‘পরিবেশ উদ্বাস্তু’দের সংখ্যা আগের যেকোনো বহির্গমনকে ছাড়িয়ে যাবে। এর ফলে লাখ লাখ মানুষ শুধু যে প্রচন্ড দুর্ভোগ ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে পড়বে তাই নয়, পাশাপাশি অবস্িথত এক দেশ আরেক দেশের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহেও লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উদ্বাস্তু সমস্যার কারণে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অসদ্ভাব অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করবে, তার সংখ্যা আগের যেকোনো সংখ্যার চেয়ে বেশি হবে, অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই সে ব্যাপারে একমত। তাই যদি হয়, তাহলে এই দুই দেশ সে সমস্যার মোকাবিলা করবে কীভাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি না। কিন্তু এ কথা জানি, পরিবেশগত কারণে যে সমস্যা ও সংকট দেখা দেবে, তার মোকাবিলা একা এদের কারও পক্ষে করা সম্ভব হবে না। যা করার দুজনে বা দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশ মিলে একযোগে করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার জনবহুল দেশগুলো, যারা প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তারা নিজেদের সমস্যা মোকাবিলায় একটি সাধারণ প্লাটফর্ম বা আলোচনাক্ষেত্র ইতিমধ্যে গড়ে তুলেছে। সেই প্লাটফর্মের নাম সার্ক। এত দিন এই আলোচনাক্ষেত্রটি কার্যত অব্যবহূত থেকে গেছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে আমাদের সবার মাথা এক করে যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের। সময় এসেছে সার্ক থেকে ‘সার্ক প্লাস’ গঠনের।
‘সার্ক প্লাস’ বলতে আমি কী বোঝাচ্ছি, সে কথা আগে বলি। ১৯৮৫ সালে সার্কের ধারণাটি যখন গৃহীত হয়, সে সময় এর সদস্যরা প্রধানত অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রসমূহে পারস্পরিক সহযোগিতার কথাই ভেবেছিল। কিন্তু ‘সার্ক প্লাস’ হবে গুণগতভাবে ভিন্ন, এর লক্ষ্য হবে সহযোগিতা নয়, সমন্বয় ও একীকরণ (ইন্টিগ্রেশন)। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো একই ভুখন্ডের অন্তর্গত, তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈপরীত্যের চেয়ে নৈকট্যই বেশি। তাদের সবার অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাত্রা অবশ্য এক নয়; যার যার অর্থনৈতিক সম্পদ ও তার ব্যবহারের সম্ভাবনাও এক রকম বা একই পর্যায়ে নয়। কেউ এক ক্ষেত্রে এগিয়ে, কেউ পিছিয়ে। কিন্তু সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের সম্পদের ব্যবহার করা গেলে এক দেশ নয়, সব দেশই লাভবান হবে। উদাহরণ হিসেবে শুধু পানি সম্পদের সমন্বিত ব্যবহারের কথা ভাবুন। হিমালয় অববাহিকায় যে পানি সম্পদ রয়েছে তার পুরোপুরি ব্যবহার সম্ভব, যদি এই অঞ্চলের দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে শুধু সহযোগিতা নয়, সমন্বয়মূলক অর্থনীতি গড়ে তোলে। এক হিসাবে দেখছি, এই পানি সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে ৮৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এখন আমরা তার ক্ষুদ্রাংশ উৎপাদন করে থাকি। একইভাবে একে অপরের স্থল পরিবহন সুযোগ সম্প্রসারণ করে পারস্পরিক বাণিজ্যের বিপুল প্রসার ঘটানোও সম্ভব।
পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের দেশগুলো এই সমন্বয়ের বিবেচনা থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন গড়ে তুলেছে। তারা কেবল অর্থনীতি নয়, নাগরিক জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই একীকরণের উদ্যাগ নিয়েছে। নতুন যে সমন্বয় কাঠামো দ্বারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিচালিত, তার কেন্দ্রে রয়েছে পণ্য, পুঁজি, শ্রমিক ও সাধারণ নাগরিক− এই চার ধরনের অবাধ যাতায়াত বা ফ্রি মুভমেন্ট। সীমানাচিহ্ন এখনো আছে তা ঠিক, কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিটি দেশের নাগরিক, তাদের পুঁজি বা পণ্য বিনা বাধায় সে চিহ্ন অতিক্রম করে এক অপরের দেশে যেতে পারে।
সার্কই যেখানে সফল হয়নি, সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধাঁচের সার্ক প্লাস গঠন খুব সহজ হবে না, তা বলাই বাহুল্য। সার্ক গঠনের পেছনে সহযোগিতা ও সমন্বয়ের বদলে রাজনৈতিক বিবেচনাই বেশি কাজ করেছে। যার যার রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থে বিন্দুমাত্র চোট লাগে এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে অঞ্চলের দেশগুলো কেউই রাজি হয়নি। তা ছাড়া আমাদের নেতাদের কাছে নাগরিক কল্যাণের বদলে নিরাপত্তার প্রশ্নটি বরাবরই অগ্রাধিকার পেয়েছে। আমরা জানি, বাণিজ্য ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠতর সহযোগিতা, এমনকি সমন্বয়ের কথা বলে ১৯৯৫ সালে ‘সাপটা’ চুক্তি এবং ২০০৪ সালে ‘সাফটা’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ছাড় দিতে রাজি না হওয়ায় এ চুক্তির কোনোটাই খুব একটা এগোয়নি। কেন এগোয়নি, তার একটি সুচিন্তিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভারতীয় কুটনীতিক মুচকুন্দ দুবে। গত বছর এপ্রিলে ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকায় এক প্রবন্ধে দুবে জানান, বিভিন্ন সময় খুব শোরগোল তুলে নানা প্রস্তাব সার্ক নেতারা নিয়েছেন, কিন্তু সেসব বাস্তবায়নের জন্য যে অংশীদারত্বের দুরদৃষ্টি বা শেয়ারড ভিশন প্রয়োজন, তা তাঁদের ছিল না। যাঁর যাঁর নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ মাথায় রেখে তাঁরা নিজেরাই সেসব প্রস্তাবের মৃত্যু ত্বরান্বিত করেছেন: ‘সার্ক প্রক্রিয়া কার্যত একে অপরকে ঠকানোর এক প্রেিতযাগিতা ছাড়া আর কিছু নয়।’
এখন জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট যখন আমাদের ওপর ক্রমান্বয়ে বোঝা হয়ে নেমে আসছে, অস্তিত্ব রক্ষার কারণেই আমাদের একীকরণ ও সমন্বয়ের কথা ভাবতে হবে। আমরা ডুবে গেলে পৃথিবীর কারও কিছু হয়তো এসে যায় না, কিন্তু আমাদের নিজেদের কিছু এসে যায় বৈকি! আমাদের বোঝা আমাদেরই বইতে হবে, অন্য কেউ তা বয়ে দেবে না।

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

Sunday, July 27, 2008

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিঃ বাংলাদেশ কি ডুবে যাবে? নাকি যাবে না?

প্রকাশঃ প্রথম আলো, ২৭ জুলাই, ২০০৮; খোলা কলম পাতা

জলবায়ুর পরিবর্তনে বাংলাদেশের বিস্তৃত ভুভাগ ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক পরিষদ (আইপিসিসি)। আরেক দল গবেষক বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লেও বাংলাদেশ ডুবে যাবে না। এ বিতর্ক ঘিরে প্রকাশ করা হলো দুটি রচনা।


বাংলাদেশ, ১৯৭১-২০৭১: রক্তে জন্ম পানিতে মরণ
জোহান হারি

আমাদের এখানে যখন বসন্ত, ওখানে তখন বর্ষাকাল। তার মধ্যে মাসজুড়ে আমি সড়কপথে ঘুরে বেরিয়েছি ওই দেশটিতে, যাকে আমরা−আমি, তুমি এবং আমরা প্রত্যেকে মিলে হত্যা করছি। একদিন সেই দেশের মুন্সিগঞ্জের এক প্রত্যন্ত গ্রামে আমরা হাজির হলাম। গ্রামবাসীর মধ্যে টিকে থাকা লোকেরা একটি পুকুরের পাড়ে বসে ছিল। তারা আমাকে বলল, দিন দিন কী অবিচারটাই না আমরা তাদের ওপর করেছি।
গ্রামটি মরতে বসে ১০ বছর আগে। প্রথমে গাছগুলো অদ্ভুত হলদে রং ধরে ও পচতে থাকে। তারপর ধানক্ষেত ডুবে যায় এবং বাড়া বন্ধ করে দেয়। নদীতে মাছ মরে পেট উল্টে ভাসতে থাকে। পশুগুলোও মরতে থাকে। তারপর একদিন শিশুরা মরে যাওয়া শুরু করে। মুন্সিগঞ্জের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর পানি একসময় ছিল মিষ্টি, স্বচ্ছ আর প্রাণে ভরা। আজ সেই পানি নোনা ও মৃত।
২৫ বছরের আরতি রানী তার দুঃখমাখা নীল শাড়ি পরে সেই পানির দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। ‘আমরা এ পানি খাই না। হঠাৎ পানি নোনা হয়ে আমাদের অসুখ-বিসুখ ধরাতে থাকে,’ তিনি বলেন। তাই আমার বাচ্চাদের পুকুরের পানি খাওয়ানো শুরু করি। জানি এই পানি ময়লা, এখানে লোকজন ময়লা পরিষ্ককার করে।’ পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘১০ বছর ধরে এই ময়লা পানি খাচ্ছি। শরীরে দুর্বল দুর্বল লাগে, পেটে ভয়ানক ব্যথাও করে। দিনে ১০ বার যেতে হয় পায়খানায়। আমার ছেলে সুপ্রিয়র বয়স তখন সাত। সারা জীবন ও এ রকম করে ভুগেছে। তারপর একদিন সকালে...।’ আরতি তারপর আমার দিকে তাকিয়ে শুধায়, ‘কেন এ রকম হলো?’
আমরাই এটা করেছি। আমাদের বিমানগুলোর প্রতিটি উড়াল, আমাদের প্রতিটি হ্যামবার্গার, আমাদের প্রতিটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র, আমাদের কারখানার ধোঁয়া সব এখানে এসে বাড়ি মারে, আর এই অবস্থা করে। আমরা পশ্চিমারা বায়ুমন্ডল দুষিত করেছি, বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়িয়ে মেরুর বরফ গলিয়ে দিচ্ছি।
বাংলাদেশ পলি দিয়ে গড়া সমতল ভুমি। এক দিকে সমুদ্র আর আরেক দিকে হিমালয় পর্বতমালার মধ্যে দেশটা যেন চুপসে আছে। এ অবস্থায় পৃথিবী যতই গরম হয়ে উঠছে, সমুদ্র যতই ফুলে-ফেঁপে উঠছে, ততই বিশ্বের মানচিত্র থেকে বাংলাদেশের মুছে যাওয়ার ভয় তৈরি হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জের ওই গ্রামের মতো বাংলাদেশের এ রকম হাজারো গ্রাম এমন করে ধুঁকছে। এর নাম লবণাক্ততা। এতে তাদের গাছগাছালি, পাখপাখালি, ফসলাদি মরে যাচ্ছে, বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে তাদের পানীয় জল।

পাহাড়ের কিনারে ঝুলন্ত
লন্ডনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে আমি এর কারণ খুঁজতে লাগলাম। আমার চোখ পড়ল এক অদ্ভুত কিন্তু বাস্তব বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনের ওপর। এটি তৈরি করেছে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিষদ (আইপিসিসি)। এখানে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৭ ভাগ জমি আর ৩০ শতাংশ আবাদ নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? কীভাবে নীরবে দুই কোটির বেশি মানুষ শ্রেফ উদ্বাস্তু হয়ে যাবে? আমি আরও খোঁজখবর শুরু করি এই আশা নিয়ে যে হয়তো দেখব এটা ঠিক নয়। আমি নাসার বিজ্ঞানী জেমস হ্যানসেনের শরণ নিলাম। তিনি জানালেন, ওই দিনই উপগ্রহ থেকে আসা চিত্র মারফত তিনি জেনেছেন, এই শতাব্দীতেই সমুদ্রের উচ্চতা ২৫ মিটার বেড়ে যাবে। এর অর্থ গোটা বাংলাদেশই ডুবে যাবে। জানা মাত্রই ঠিক করলাম, যেতে হবে ওই দেশে।
বাংলাদেশের ভিড়, কোলাহল আর সবকিছু আটকে থাকা পরিস্িথতির মধ্যে আমি হাজির হলাম ড. আতিক রহমানের দপ্তরে। তিনি আইপিসিসির খ্যাতনামা বিজ্ঞানী। জলবায়ু পরিবর্তনের হুঁশিয়ারি দেওয়ার জন্য জাতিসংঘ তাঁকে পুরস্কৃত করেছে। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশে বসে আরও তথ্য হাতে নিয়ে আমার এখন মনে হচ্ছে, আইপিসিসির প্রতিবেদন বিপদের মাত্রাকে কমিয়েই দেখিয়েছে।’ হ্যাঁ, তাঁরই এটা জানার কথা, তাঁর বই বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। তিনি বলে যান, ‘এই দেশে আমরা একটা বিপর্যয় হানা দিতে দেখছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই ভুখন্ডের মানবপ্রজাতির বিরাট উচ্ছেদ। এটা হচ্ছে, বৈশ্বিক জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রধান আঘাতস্থল−গ্রাউন্ড জিরো।’
তিনি একে একে বিপর্যয়ের ছবি এঁকে গেলেন, ‘গত কয়েক যুগে দেশের বৃহত্তম দ্বীপ ভোলার অর্ধেকটা সমুদ্র খেয়ে নিয়েছে। এভাবে বাইরের ভুমি চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে নদীগুলো বাড়তে বাড়তে তুঙ্গে উঠে পাড় ভাঙতে ভাঙতে ভেতরের ভুমিও গ্রাস করছে। ভুমিক্ষয়ের মাত্র ৪০ শতাংশ। ঘন ঘন উত্তরোত্তর প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড় হচ্ছে। নোনা পানি মাটিকে অনুর্বর করে তুলছে।’ এইবার ড. আতিক রহমান বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে এর জন্য মানুষই দায়ী। পশ্চিমের মানুষেরা তাদের কৃতকর্মের পরিমাণ বুঝতে চাইলে খুব সোজা পথ আছে। প্রতি ১০ হাজার টন কার্বন ছাড়লে তাদের উচিত একটি করে বাংলাদেশি পরিবারকে তাদের কাছে নিয়ে যাওয়া। যা করা হচ্ছে, তা জলবায়ুজনিত গণহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়। যদি বিশ্বের কোনো ভুমিভিত্তিক বরফের আচ্ছাদন গলে যায়, তাহলেই ঢাকাসহ আমাদের দেশের ৭০-৮০ ভাগ অঞ্চল ডুবে যাবে।’

এ পরিস্িথতির মধ্যে আমরা নেই অথচ আমরাই এর জন্য দায়ী। যা হবে তা খুব দ্রুতই হবে এবং এর প্রতিকার করা যাবে না। বাংলাদেশ আইওয়ার সমান একটি দেশ। অথচ এর মধ্যেই বাস করে ১৫ কোটি মানুষ। অবিশ্বাস্য! এত জীবন কি সত্যিই পাহাড়ের ঢাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যাবে?

সমুদ্র যেন পাগল হয়ে গেছে
এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি সেখানে, যেখানে গত বছরের ১৫ নভেম্বর সাইক্লোন সিডর আঘাত হেনেছিল। ঘুর্ণিঝড়টি তৈরি হয়েছিল উষ্ণ বঙ্গোপসাগরে। তারপর এখানে এসে আছড়ে পড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কমপক্ষে তিন হাজার মানুষকে। রেখে যায় মাইলের পর মাইল উপড়ানো গাছপালা ও ঘরবাড়ি। বাংলাদেশে সাইক্লোন আগেও ছিল, এখনো আছে। কিন্তু এখন যেন তার চাপ ও তাপ অনেক বেড়ে গেছে। জলবায়ু বিজ্ঞানী আহসান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঘুর্ণিঝড়ের জন্য উষ্ণ আবহাওয়া জ্বালানির কাজ করে। ৪০ বছর ধরে বঙ্গোপসাগরের উপরিতলের উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বেড়েছে ঘুর্ণিঝড়ের হানা দেওয়ার হার। এখন তা গড়ে ৩৯ শতাংশ।’
চরকাশেমের হানিফ মৃধা আমাকে সমুদ্রের ভেতরে একটি বিন্দু দেখিয়ে বলে, ‘ওই যে গাছটি দেখছেন, আগে ওখানে আমার বাড়ি ছিল। তারপর থেকে এ চরে থাকতাম। সিডরের দিন রাত আটটার দিকে বাতাস বাড়তে দেখি। আমি দৌড়ে একটা টিনের চালার নিচে যাই। বাতাস সেটাও উড়িয়ে নিয়ে যায়। হঠাৎ পানির তোড় ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের ওপর। আমি আমার একটি বাচ্চাকে নিয়ে বনের দিকে দৌড়াই এবং সবচেয়ে উঁচুটার মগডালে গিয়ে বসি। পানি সেখানেও চড়তে থাকলে ভাবি, আজই আমার দিন শেষ। আমি মারা যাব, আমার বউ-বাচ্চারা সবাই মারা যাবে...পানি নেমে গেলে দেখি, সব ভেসে গেছে।’

একটি দেশের সমাধিলিপি
ঢাকার একটি ক্যাফেতে বসে কথা বলছিলাম তাহমিমা আনামের সঙ্গে। বাংলাদেশে জন্ন নিয়ে ৩২ বছর বয়সী এই লেখিকা এ গোল্ডেন এজ নামে উপন্যাস লিখেছেন। অনেক দিন পর তিনি দেশে ফিরেছেন। নতুন আরেকটি উপন্যাসের পরিকল্পনা করছেন তিনি। ‘যা ঘটার তা শুরু হয়ে গেছে। দেশটা যে ডুবে যাবে, তা এখন সবাই বুঝতে শুরু করেছে। এই ১৫ কোটি মানুষ কোথায় পালাবে? ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রেখেছে। সেদিকে যাওয়া যাবে না। মিয়ানমার থেকেও তেমন সাহায্য আসবে না। জলবায়ু পরির্বতনের প্রথম আঘাত আমাদের ওপর দিয়েই যাবে। সবারই উচিত বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখা। আজ যা আমাদের ওপর দিয়ে হচ্ছে, একদিন তা সবাইকেই ভোগ করতে হবে। আমরা হলাম তোমাদের ভবিষ্যৎ।’
আমি বুঝলাম, আমরা যদি এভাবে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করতে থাকি, দুষিত করতে থাকি, তাহলে বাংলাদেশের বিনাশ অনিবার্য। দেশটা যেন একটা ভেলা। এটা ডুবলে মানুষগুলোও ডুবে যাবে। আনাম বলতে থাকেন, ‘কিংবা আমরা হয়তো দুরের কোনো উপকুলে ভেসে গিয়ে ঠেকব। তখন বাংলাদেশ নামে কোনো দেশ থাকবে না। কেবল আমাদের নামে কোথাও হয়তো একটা সমাধিফলক পোঁতা হবে। তাতে লেখা থাকবে, বাংলাদেশ, ১৯৭১-২০৭১: রক্তে জন্ন পানিতে মরণ।’

ব্রিটেনের দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুদিত
জোহান হারি: ব্রিটিশ সাংবাদিক।



না, বাংলাদেশ তলিয়ে যাবে না

এম এইচ খান

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অনেকেরই আশঙ্কা, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বেড়ে পৃথিবীর অনেক দেশেরই নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবে। এ বিষয়ে হাসান ফেরদৌসের লেখা ‘বাংলাদেশ যদি তলিয়ে যায়...’ শীর্ষক একটি নিবন্ধই (প্রথম আলো, ১১ এপ্রিল ২০০৮) আমার এ লেখার পশ্চাৎপট। আফসান চৌধুরী নির্মিত ‘ডাজ এনিবডি কেয়ার ইফ বাংলাদেশ ড্রাউনস?’ শীর্ষক একটি তথ্যচিত্রের বরাত দিয়ে হাসান ফেরদৌস লিখেছেন, ‘ভু-উপরিভাগের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বা সি-লেভেল বেড়ে যাবে। তার ফলে বাংলাদেশের উপকুলবর্তী ও নিচু বিস্তীর্ণ অঞ্চল আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ...বাংলাদেশের সমুদ্র-উপকুলবর্তী কোনো কোনো এলাকা ইতিমধ্যে তলিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। সমুদ্র এখন অনেক কাছে চলে এসেছে। প্লাবিত এলাকা ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ দলবেঁধে ঘর ছাড়তে শুরু করেছে।’
রীতিমতো আতঙ্কিত হওয়ার মতো তথ্য। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় এ রকম কিছু ঘটলে, তা হবে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়লে যে দেশগুলো ভুখন্ড হারাবে বলা হচ্ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। তবে হাসান ফেরদৌসের লেখায় উপকুলবর্তী কোনো কোনো এলাকা ইতিমধ্যে তলিয়ে যাওয়ার যে উল্লেখ রয়েছে, সে রকম তথ্য আমাদের হাতে নেই। সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে এখানে কেউ কেউ ক্ষুদ্র পরিসরে গবেষণা করছেন বটে, মানুষের জীবনযাত্রায় এর লক্ষণীয় প্রভাব এখনো স্পষ্ট নয়।
সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়ছে বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁরাও স্বীকার করেন, এ পরিবর্তন সঠিক পরিমাপ করা কঠিন। নানা উপাত্ত বিশ্লেষণ থেকে তাঁদের ধারণা হয়েছে, গত ১০০ বছরে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা সম্ভবত ১০ থেকে ২৫ সেমি বেড়েছে। এটুকু পরিবর্তন ১০০ বছরে হয়ে থাকলে, সে কারণে হঠাৎ কোনো জনগোষ্ঠীর বসতভিটা ছেড়ে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আফসান চৌধুরীর তথ্যচিত্রে ঘরছাড়া মানুষের ছবি দেওয়া হয়েছে। কীভাবে এটি সম্ভব হলো?
সাগর উঁচু হয়ে ভুমি তলিয়ে গেছে এমন তথ্য না থাকলেও, নব্বইয়ের দশকে বিলডাকাতিয়া বা বর্তমান সময়ে ভবদহের জলাবদ্ধতার কারণে সৃষ্ট জনদুর্ভোগের কথা এ দেশে কমবেশি সবারই জানা। এসব জলাবদ্ধতার ফলে মানুষের জীবন-জীবিকা যেমন বদলে গেছে, তেমনি কাজের অভাবে বসতভিটা ছেড়েছে অনেকে। উল্লিখিত ছবি কি এসব ঘরছাড়া মানুষের?
এ জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পেছনে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়ার কোনো ভুমিকা নেই। এগুলো সৃষ্টি হয়েছে উপকুল অঞ্চলে অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ (পোল্ডার) নির্মাণের ফলে। যাঁরা বাংলাদেশের হাইড্রো-জিওলজি বা ভুমি-নদী-পানির সম্পর্ক বিষয়ে ধারণা রাখেন, তাঁদের কাছে এ জলাবদ্ধতা সৃষ্টির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। মনুষ্যসৃষ্ট এসব জলাবদ্ধতার কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে এমন মানুষের ছবি দেখিয়ে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়ার ব্যাখ্যা করলে, তা সংশ্লিষ্ট মহলে একটি ভুল বার্তা পৌঁছে দেবে।
বর্তমান নয়, সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়ার বিষয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ ভবিষ্যৎকে নিয়ে। সম্ভাব্য উচ্চতা বাড়ার মাত্রা নিয়ে নানা মত রয়েছে। তাই বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে বিভিন্ন সম্ভাব্য চিত্রের (সিনারিও) আলোকে, বাংলাদেশ বা মালদ্বীপের মতো দেশে এর কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন। তবে তাঁদের বক্তব্যের সার কথা, এসব দেশের উল্লেখযোগ্য অংশ সাগরে তলিয়ে যাবে। সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়লে, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের ওপর একই ধরনের প্রভাব পড়বে বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁরা বিষয়টিকে অতিমাত্রায় সরলীকরণের চেষ্টা করছেন। বাস্তবিক অর্থে, সমুদ্রপিঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে মালদ্বীপের ওই পরিমাণ উঁচু ভুখন্ড সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন কিছু না-ও ঘটতে পারে। বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়:
মালদ্বীপ সৃষ্টি হয়েছে প্রায় এক হাজার ২০০ ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে, যেগুলোর উচ্চতা সমুদ্রপিঠ থেকে চার ফুটেরও কম। সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়লে তা মোকাবিলায় এসব দ্বীপে ভুমির উচ্চতা বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে তলিয়ে যাওয়াই হবে এর অবধারিত পরিণতি। অন্যদিকে, বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। হিমালয় পর্বতমালা থেকে সৃষ্ট বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নদী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মিলনস্থলে অবস্িথত বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ। এ দেশের শতকরা নব্বই ভাগ ভুমি সৃষ্টি হয়েছে প্রমত্তা এ নদীগুলোর বয়ে আনা পলিতে। এ কারণেই উপকুলবর্তী এলাকায় ভুমির উচ্চতা সমুদ্রপিঠের কাছাকাছি। এশিয়ার বৃহত্তম এ নদীগুলো প্রতিবছর বিপুল পলি বয়ে নেয় সাগরে, যার কিছু অংশ প্লাবনের সময় ভুমির ওপরে জমা পড়ে। এ প্রক্রিয়ায় একদিকে অতি ধীরে বাড়ছে ভুমির উচ্চতা, অন্যদিকে সাগরের তলদেশে রচিত হচ্ছে নতুন ভুখন্ডের ভিত। প্রাকৃতিকভাবে এখানে ভুমি গঠনের এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা এখনো ক্রিয়াশীল। সাগরের উচ্চতা বাড়লে এ প্রক্রিয়াতেই তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারে বাংলাদেশের উপকুলবর্তী এলাকা। সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়লে তা ঘটবে অতি ধীরে, বছরে মাত্র কয়েক মিলিমিটার হারে। এরূপ পরিস্িথতিতে বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে, তা তিনটি সম্ভাব্য চিত্রের আলোকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
ভুমিরক্ষায় কোনো ব্যবস্থা না নিলে: এ পরিস্িথতে হাইড্রো-জিওলজিক প্রক্রিয়া প্রাকৃতিকভাবে কার্যকর থাকবে এবং সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়ার ফলে বর্ষা মৌসুমে প্লাবনের মাত্রা ও সংখ্যা উভয়ই বেড়ে যাবে। এতে পলি জমে ভুমির উচ্চতা বাড়ার হার বাড়বে। অর্থাৎ, সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভুমির উচ্চতাও বাড়তে থাকবে। ভুমি তলিয়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা, তা বাস্তবিক অর্থে না-ও ঘটতে পারে। সমস্যা যা হবে তা হলো ঘন ঘন বন্যায় সম্পদ ও কৃষির ক্ষয়ক্ষতিসহ সাধারণ ভোগান্তি বেড়ে যাওয়া। এ দেশের মানুষ বন্যার ভোগান্তিকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হলেও, অর্থনৈতিক ক্ষতিই এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দেবে।
সাগরকে রুখতে উপকুলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলে: হাইড্রো-জিওলজির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ওপর যেকোনো অপরিকল্পিত হস্তক্ষেপ বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। অতীতে এভাবেই অনেক অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ জলাবদ্ধতায় ডুবে গেছে। উল্লেখ্য, সাগর থেকে পানি এসে নয়, বরং নিষ্ককাশনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ায়, বৃষ্টি বা নদীর পানি জমেই সৃষ্টি হয়েছে এসব জলাবদ্ধতা। পরিবর্তিত পরিস্িথতিতে এ ধরনের বেড়িবাঁধ জলাবদ্ধতাকে আরও বাড়িয়ে দেবে।
ভুমির উচ্চতা বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে ব্যবস্থা নিলে: সুপরিকল্পিতভাবে ভুমি ও বন্যাব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উপকুলীয় এলাকায় ভুমির উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব। এ ধরনের ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হবে নদীগুলো যে পলি সাগরে বয়ে নেয়, তার আরও বেশি অংশ ভুমিতে নিয়ে আসা। সংশ্লিষ্ট এলাকায় ছোট ছোট নদী, খাল ইত্যাদির সংস্কার ও নিয়ন্ত্রক বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে প্রয়োজনমতো নদীর পলিসমৃদ্ধ পানি স্থলভাগে প্রবাহিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। পানির স্বাভাবিক নিষ্ককাশনের নিশ্চয়তাসহ, এটি হবে অনেকটা বন্যাকে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করার মতো ব্যবস্থা। এভাবে বন্যা শেষে জমা করা পলি ভুমির উচ্চতা বাড়িয়ে দেবে। উপকুল এলাকাকে অনেক ভাগে বিভক্ত করে, সুবিধামতো এক বা একাধিক অংশে এ উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হতে পারে। কয়েক বছরের মধ্যে এটি উন্নত হলে, অন্য এলাকা এ কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে। দুটি বিষয় এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক হিসেবে দেখা দেবে: ক. বাঁধ নির্মাণ ও নদী সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান। খ. নিয়ন্ত্রিতভাবে ভুমি ব্যবহারের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি।
আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়লে, বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবে কি যাবে না, সেটা নির্ভর করবে এ দেশের মানুষ ভুমিসম্পদ সংরক্ষণে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার ওপর। কিছুই না করা হলে, প্রকৃতি নিজেই তার সৃষ্ট ভুখন্ড তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষায় কার্যকর ভুমিকা নেবে। সাগরকে ঠেকিয়ে রাখতে ভুল পদ্ধতিতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলে, তা ভুমির তলিয়ে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করবে। ‘ভুমি-নদী-পানির সম্পর্ক’কে বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পিত ব্যবস্থা গড়ে তুললে, ভুমি উন্নয়নের মাধ্যমে এ পরিস্িথতি সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

ড. এম এইচ খান: অধ্যাপক, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বাকৃবি, ময়মনসিংহ।