Sunday, July 27, 2008

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিঃ বাংলাদেশ কি ডুবে যাবে? নাকি যাবে না?

প্রকাশঃ প্রথম আলো, ২৭ জুলাই, ২০০৮; খোলা কলম পাতা

জলবায়ুর পরিবর্তনে বাংলাদেশের বিস্তৃত ভুভাগ ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক পরিষদ (আইপিসিসি)। আরেক দল গবেষক বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লেও বাংলাদেশ ডুবে যাবে না। এ বিতর্ক ঘিরে প্রকাশ করা হলো দুটি রচনা।


বাংলাদেশ, ১৯৭১-২০৭১: রক্তে জন্ম পানিতে মরণ
জোহান হারি

আমাদের এখানে যখন বসন্ত, ওখানে তখন বর্ষাকাল। তার মধ্যে মাসজুড়ে আমি সড়কপথে ঘুরে বেরিয়েছি ওই দেশটিতে, যাকে আমরা−আমি, তুমি এবং আমরা প্রত্যেকে মিলে হত্যা করছি। একদিন সেই দেশের মুন্সিগঞ্জের এক প্রত্যন্ত গ্রামে আমরা হাজির হলাম। গ্রামবাসীর মধ্যে টিকে থাকা লোকেরা একটি পুকুরের পাড়ে বসে ছিল। তারা আমাকে বলল, দিন দিন কী অবিচারটাই না আমরা তাদের ওপর করেছি।
গ্রামটি মরতে বসে ১০ বছর আগে। প্রথমে গাছগুলো অদ্ভুত হলদে রং ধরে ও পচতে থাকে। তারপর ধানক্ষেত ডুবে যায় এবং বাড়া বন্ধ করে দেয়। নদীতে মাছ মরে পেট উল্টে ভাসতে থাকে। পশুগুলোও মরতে থাকে। তারপর একদিন শিশুরা মরে যাওয়া শুরু করে। মুন্সিগঞ্জের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর পানি একসময় ছিল মিষ্টি, স্বচ্ছ আর প্রাণে ভরা। আজ সেই পানি নোনা ও মৃত।
২৫ বছরের আরতি রানী তার দুঃখমাখা নীল শাড়ি পরে সেই পানির দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। ‘আমরা এ পানি খাই না। হঠাৎ পানি নোনা হয়ে আমাদের অসুখ-বিসুখ ধরাতে থাকে,’ তিনি বলেন। তাই আমার বাচ্চাদের পুকুরের পানি খাওয়ানো শুরু করি। জানি এই পানি ময়লা, এখানে লোকজন ময়লা পরিষ্ককার করে।’ পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, ‘১০ বছর ধরে এই ময়লা পানি খাচ্ছি। শরীরে দুর্বল দুর্বল লাগে, পেটে ভয়ানক ব্যথাও করে। দিনে ১০ বার যেতে হয় পায়খানায়। আমার ছেলে সুপ্রিয়র বয়স তখন সাত। সারা জীবন ও এ রকম করে ভুগেছে। তারপর একদিন সকালে...।’ আরতি তারপর আমার দিকে তাকিয়ে শুধায়, ‘কেন এ রকম হলো?’
আমরাই এটা করেছি। আমাদের বিমানগুলোর প্রতিটি উড়াল, আমাদের প্রতিটি হ্যামবার্গার, আমাদের প্রতিটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র, আমাদের কারখানার ধোঁয়া সব এখানে এসে বাড়ি মারে, আর এই অবস্থা করে। আমরা পশ্চিমারা বায়ুমন্ডল দুষিত করেছি, বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়িয়ে মেরুর বরফ গলিয়ে দিচ্ছি।
বাংলাদেশ পলি দিয়ে গড়া সমতল ভুমি। এক দিকে সমুদ্র আর আরেক দিকে হিমালয় পর্বতমালার মধ্যে দেশটা যেন চুপসে আছে। এ অবস্থায় পৃথিবী যতই গরম হয়ে উঠছে, সমুদ্র যতই ফুলে-ফেঁপে উঠছে, ততই বিশ্বের মানচিত্র থেকে বাংলাদেশের মুছে যাওয়ার ভয় তৈরি হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জের ওই গ্রামের মতো বাংলাদেশের এ রকম হাজারো গ্রাম এমন করে ধুঁকছে। এর নাম লবণাক্ততা। এতে তাদের গাছগাছালি, পাখপাখালি, ফসলাদি মরে যাচ্ছে, বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে তাদের পানীয় জল।

পাহাড়ের কিনারে ঝুলন্ত
লন্ডনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে আমি এর কারণ খুঁজতে লাগলাম। আমার চোখ পড়ল এক অদ্ভুত কিন্তু বাস্তব বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনের ওপর। এটি তৈরি করেছে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিষদ (আইপিসিসি)। এখানে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৭ ভাগ জমি আর ৩০ শতাংশ আবাদ নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? কীভাবে নীরবে দুই কোটির বেশি মানুষ শ্রেফ উদ্বাস্তু হয়ে যাবে? আমি আরও খোঁজখবর শুরু করি এই আশা নিয়ে যে হয়তো দেখব এটা ঠিক নয়। আমি নাসার বিজ্ঞানী জেমস হ্যানসেনের শরণ নিলাম। তিনি জানালেন, ওই দিনই উপগ্রহ থেকে আসা চিত্র মারফত তিনি জেনেছেন, এই শতাব্দীতেই সমুদ্রের উচ্চতা ২৫ মিটার বেড়ে যাবে। এর অর্থ গোটা বাংলাদেশই ডুবে যাবে। জানা মাত্রই ঠিক করলাম, যেতে হবে ওই দেশে।
বাংলাদেশের ভিড়, কোলাহল আর সবকিছু আটকে থাকা পরিস্িথতির মধ্যে আমি হাজির হলাম ড. আতিক রহমানের দপ্তরে। তিনি আইপিসিসির খ্যাতনামা বিজ্ঞানী। জলবায়ু পরিবর্তনের হুঁশিয়ারি দেওয়ার জন্য জাতিসংঘ তাঁকে পুরস্কৃত করেছে। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশে বসে আরও তথ্য হাতে নিয়ে আমার এখন মনে হচ্ছে, আইপিসিসির প্রতিবেদন বিপদের মাত্রাকে কমিয়েই দেখিয়েছে।’ হ্যাঁ, তাঁরই এটা জানার কথা, তাঁর বই বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। তিনি বলে যান, ‘এই দেশে আমরা একটা বিপর্যয় হানা দিতে দেখছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই ভুখন্ডের মানবপ্রজাতির বিরাট উচ্ছেদ। এটা হচ্ছে, বৈশ্বিক জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রধান আঘাতস্থল−গ্রাউন্ড জিরো।’
তিনি একে একে বিপর্যয়ের ছবি এঁকে গেলেন, ‘গত কয়েক যুগে দেশের বৃহত্তম দ্বীপ ভোলার অর্ধেকটা সমুদ্র খেয়ে নিয়েছে। এভাবে বাইরের ভুমি চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে নদীগুলো বাড়তে বাড়তে তুঙ্গে উঠে পাড় ভাঙতে ভাঙতে ভেতরের ভুমিও গ্রাস করছে। ভুমিক্ষয়ের মাত্র ৪০ শতাংশ। ঘন ঘন উত্তরোত্তর প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড় হচ্ছে। নোনা পানি মাটিকে অনুর্বর করে তুলছে।’ এইবার ড. আতিক রহমান বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে এর জন্য মানুষই দায়ী। পশ্চিমের মানুষেরা তাদের কৃতকর্মের পরিমাণ বুঝতে চাইলে খুব সোজা পথ আছে। প্রতি ১০ হাজার টন কার্বন ছাড়লে তাদের উচিত একটি করে বাংলাদেশি পরিবারকে তাদের কাছে নিয়ে যাওয়া। যা করা হচ্ছে, তা জলবায়ুজনিত গণহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়। যদি বিশ্বের কোনো ভুমিভিত্তিক বরফের আচ্ছাদন গলে যায়, তাহলেই ঢাকাসহ আমাদের দেশের ৭০-৮০ ভাগ অঞ্চল ডুবে যাবে।’

এ পরিস্িথতির মধ্যে আমরা নেই অথচ আমরাই এর জন্য দায়ী। যা হবে তা খুব দ্রুতই হবে এবং এর প্রতিকার করা যাবে না। বাংলাদেশ আইওয়ার সমান একটি দেশ। অথচ এর মধ্যেই বাস করে ১৫ কোটি মানুষ। অবিশ্বাস্য! এত জীবন কি সত্যিই পাহাড়ের ঢাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যাবে?

সমুদ্র যেন পাগল হয়ে গেছে
এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি সেখানে, যেখানে গত বছরের ১৫ নভেম্বর সাইক্লোন সিডর আঘাত হেনেছিল। ঘুর্ণিঝড়টি তৈরি হয়েছিল উষ্ণ বঙ্গোপসাগরে। তারপর এখানে এসে আছড়ে পড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কমপক্ষে তিন হাজার মানুষকে। রেখে যায় মাইলের পর মাইল উপড়ানো গাছপালা ও ঘরবাড়ি। বাংলাদেশে সাইক্লোন আগেও ছিল, এখনো আছে। কিন্তু এখন যেন তার চাপ ও তাপ অনেক বেড়ে গেছে। জলবায়ু বিজ্ঞানী আহসান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঘুর্ণিঝড়ের জন্য উষ্ণ আবহাওয়া জ্বালানির কাজ করে। ৪০ বছর ধরে বঙ্গোপসাগরের উপরিতলের উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বেড়েছে ঘুর্ণিঝড়ের হানা দেওয়ার হার। এখন তা গড়ে ৩৯ শতাংশ।’
চরকাশেমের হানিফ মৃধা আমাকে সমুদ্রের ভেতরে একটি বিন্দু দেখিয়ে বলে, ‘ওই যে গাছটি দেখছেন, আগে ওখানে আমার বাড়ি ছিল। তারপর থেকে এ চরে থাকতাম। সিডরের দিন রাত আটটার দিকে বাতাস বাড়তে দেখি। আমি দৌড়ে একটা টিনের চালার নিচে যাই। বাতাস সেটাও উড়িয়ে নিয়ে যায়। হঠাৎ পানির তোড় ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের ওপর। আমি আমার একটি বাচ্চাকে নিয়ে বনের দিকে দৌড়াই এবং সবচেয়ে উঁচুটার মগডালে গিয়ে বসি। পানি সেখানেও চড়তে থাকলে ভাবি, আজই আমার দিন শেষ। আমি মারা যাব, আমার বউ-বাচ্চারা সবাই মারা যাবে...পানি নেমে গেলে দেখি, সব ভেসে গেছে।’

একটি দেশের সমাধিলিপি
ঢাকার একটি ক্যাফেতে বসে কথা বলছিলাম তাহমিমা আনামের সঙ্গে। বাংলাদেশে জন্ন নিয়ে ৩২ বছর বয়সী এই লেখিকা এ গোল্ডেন এজ নামে উপন্যাস লিখেছেন। অনেক দিন পর তিনি দেশে ফিরেছেন। নতুন আরেকটি উপন্যাসের পরিকল্পনা করছেন তিনি। ‘যা ঘটার তা শুরু হয়ে গেছে। দেশটা যে ডুবে যাবে, তা এখন সবাই বুঝতে শুরু করেছে। এই ১৫ কোটি মানুষ কোথায় পালাবে? ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রেখেছে। সেদিকে যাওয়া যাবে না। মিয়ানমার থেকেও তেমন সাহায্য আসবে না। জলবায়ু পরির্বতনের প্রথম আঘাত আমাদের ওপর দিয়েই যাবে। সবারই উচিত বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখা। আজ যা আমাদের ওপর দিয়ে হচ্ছে, একদিন তা সবাইকেই ভোগ করতে হবে। আমরা হলাম তোমাদের ভবিষ্যৎ।’
আমি বুঝলাম, আমরা যদি এভাবে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করতে থাকি, দুষিত করতে থাকি, তাহলে বাংলাদেশের বিনাশ অনিবার্য। দেশটা যেন একটা ভেলা। এটা ডুবলে মানুষগুলোও ডুবে যাবে। আনাম বলতে থাকেন, ‘কিংবা আমরা হয়তো দুরের কোনো উপকুলে ভেসে গিয়ে ঠেকব। তখন বাংলাদেশ নামে কোনো দেশ থাকবে না। কেবল আমাদের নামে কোথাও হয়তো একটা সমাধিফলক পোঁতা হবে। তাতে লেখা থাকবে, বাংলাদেশ, ১৯৭১-২০৭১: রক্তে জন্ন পানিতে মরণ।’

ব্রিটেনের দি ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুদিত
জোহান হারি: ব্রিটিশ সাংবাদিক।



না, বাংলাদেশ তলিয়ে যাবে না

এম এইচ খান

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অনেকেরই আশঙ্কা, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বেড়ে পৃথিবীর অনেক দেশেরই নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবে। এ বিষয়ে হাসান ফেরদৌসের লেখা ‘বাংলাদেশ যদি তলিয়ে যায়...’ শীর্ষক একটি নিবন্ধই (প্রথম আলো, ১১ এপ্রিল ২০০৮) আমার এ লেখার পশ্চাৎপট। আফসান চৌধুরী নির্মিত ‘ডাজ এনিবডি কেয়ার ইফ বাংলাদেশ ড্রাউনস?’ শীর্ষক একটি তথ্যচিত্রের বরাত দিয়ে হাসান ফেরদৌস লিখেছেন, ‘ভু-উপরিভাগের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বা সি-লেভেল বেড়ে যাবে। তার ফলে বাংলাদেশের উপকুলবর্তী ও নিচু বিস্তীর্ণ অঞ্চল আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ...বাংলাদেশের সমুদ্র-উপকুলবর্তী কোনো কোনো এলাকা ইতিমধ্যে তলিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। সমুদ্র এখন অনেক কাছে চলে এসেছে। প্লাবিত এলাকা ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ দলবেঁধে ঘর ছাড়তে শুরু করেছে।’
রীতিমতো আতঙ্কিত হওয়ার মতো তথ্য। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় এ রকম কিছু ঘটলে, তা হবে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়লে যে দেশগুলো ভুখন্ড হারাবে বলা হচ্ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। তবে হাসান ফেরদৌসের লেখায় উপকুলবর্তী কোনো কোনো এলাকা ইতিমধ্যে তলিয়ে যাওয়ার যে উল্লেখ রয়েছে, সে রকম তথ্য আমাদের হাতে নেই। সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে এখানে কেউ কেউ ক্ষুদ্র পরিসরে গবেষণা করছেন বটে, মানুষের জীবনযাত্রায় এর লক্ষণীয় প্রভাব এখনো স্পষ্ট নয়।
সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়ছে বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁরাও স্বীকার করেন, এ পরিবর্তন সঠিক পরিমাপ করা কঠিন। নানা উপাত্ত বিশ্লেষণ থেকে তাঁদের ধারণা হয়েছে, গত ১০০ বছরে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা সম্ভবত ১০ থেকে ২৫ সেমি বেড়েছে। এটুকু পরিবর্তন ১০০ বছরে হয়ে থাকলে, সে কারণে হঠাৎ কোনো জনগোষ্ঠীর বসতভিটা ছেড়ে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আফসান চৌধুরীর তথ্যচিত্রে ঘরছাড়া মানুষের ছবি দেওয়া হয়েছে। কীভাবে এটি সম্ভব হলো?
সাগর উঁচু হয়ে ভুমি তলিয়ে গেছে এমন তথ্য না থাকলেও, নব্বইয়ের দশকে বিলডাকাতিয়া বা বর্তমান সময়ে ভবদহের জলাবদ্ধতার কারণে সৃষ্ট জনদুর্ভোগের কথা এ দেশে কমবেশি সবারই জানা। এসব জলাবদ্ধতার ফলে মানুষের জীবন-জীবিকা যেমন বদলে গেছে, তেমনি কাজের অভাবে বসতভিটা ছেড়েছে অনেকে। উল্লিখিত ছবি কি এসব ঘরছাড়া মানুষের?
এ জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পেছনে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়ার কোনো ভুমিকা নেই। এগুলো সৃষ্টি হয়েছে উপকুল অঞ্চলে অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ (পোল্ডার) নির্মাণের ফলে। যাঁরা বাংলাদেশের হাইড্রো-জিওলজি বা ভুমি-নদী-পানির সম্পর্ক বিষয়ে ধারণা রাখেন, তাঁদের কাছে এ জলাবদ্ধতা সৃষ্টির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। মনুষ্যসৃষ্ট এসব জলাবদ্ধতার কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে এমন মানুষের ছবি দেখিয়ে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়ার ব্যাখ্যা করলে, তা সংশ্লিষ্ট মহলে একটি ভুল বার্তা পৌঁছে দেবে।
বর্তমান নয়, সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়ার বিষয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ ভবিষ্যৎকে নিয়ে। সম্ভাব্য উচ্চতা বাড়ার মাত্রা নিয়ে নানা মত রয়েছে। তাই বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে বিভিন্ন সম্ভাব্য চিত্রের (সিনারিও) আলোকে, বাংলাদেশ বা মালদ্বীপের মতো দেশে এর কী প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন। তবে তাঁদের বক্তব্যের সার কথা, এসব দেশের উল্লেখযোগ্য অংশ সাগরে তলিয়ে যাবে। সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়লে, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের ওপর একই ধরনের প্রভাব পড়বে বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁরা বিষয়টিকে অতিমাত্রায় সরলীকরণের চেষ্টা করছেন। বাস্তবিক অর্থে, সমুদ্রপিঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে মালদ্বীপের ওই পরিমাণ উঁচু ভুখন্ড সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন কিছু না-ও ঘটতে পারে। বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়:
মালদ্বীপ সৃষ্টি হয়েছে প্রায় এক হাজার ২০০ ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে, যেগুলোর উচ্চতা সমুদ্রপিঠ থেকে চার ফুটেরও কম। সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়লে তা মোকাবিলায় এসব দ্বীপে ভুমির উচ্চতা বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে তলিয়ে যাওয়াই হবে এর অবধারিত পরিণতি। অন্যদিকে, বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। হিমালয় পর্বতমালা থেকে সৃষ্ট বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নদী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মিলনস্থলে অবস্িথত বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ। এ দেশের শতকরা নব্বই ভাগ ভুমি সৃষ্টি হয়েছে প্রমত্তা এ নদীগুলোর বয়ে আনা পলিতে। এ কারণেই উপকুলবর্তী এলাকায় ভুমির উচ্চতা সমুদ্রপিঠের কাছাকাছি। এশিয়ার বৃহত্তম এ নদীগুলো প্রতিবছর বিপুল পলি বয়ে নেয় সাগরে, যার কিছু অংশ প্লাবনের সময় ভুমির ওপরে জমা পড়ে। এ প্রক্রিয়ায় একদিকে অতি ধীরে বাড়ছে ভুমির উচ্চতা, অন্যদিকে সাগরের তলদেশে রচিত হচ্ছে নতুন ভুখন্ডের ভিত। প্রাকৃতিকভাবে এখানে ভুমি গঠনের এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা এখনো ক্রিয়াশীল। সাগরের উচ্চতা বাড়লে এ প্রক্রিয়াতেই তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারে বাংলাদেশের উপকুলবর্তী এলাকা। সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়লে তা ঘটবে অতি ধীরে, বছরে মাত্র কয়েক মিলিমিটার হারে। এরূপ পরিস্িথতিতে বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে, তা তিনটি সম্ভাব্য চিত্রের আলোকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
ভুমিরক্ষায় কোনো ব্যবস্থা না নিলে: এ পরিস্িথতে হাইড্রো-জিওলজিক প্রক্রিয়া প্রাকৃতিকভাবে কার্যকর থাকবে এবং সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়ার ফলে বর্ষা মৌসুমে প্লাবনের মাত্রা ও সংখ্যা উভয়ই বেড়ে যাবে। এতে পলি জমে ভুমির উচ্চতা বাড়ার হার বাড়বে। অর্থাৎ, সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভুমির উচ্চতাও বাড়তে থাকবে। ভুমি তলিয়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা, তা বাস্তবিক অর্থে না-ও ঘটতে পারে। সমস্যা যা হবে তা হলো ঘন ঘন বন্যায় সম্পদ ও কৃষির ক্ষয়ক্ষতিসহ সাধারণ ভোগান্তি বেড়ে যাওয়া। এ দেশের মানুষ বন্যার ভোগান্তিকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হলেও, অর্থনৈতিক ক্ষতিই এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দেবে।
সাগরকে রুখতে উপকুলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলে: হাইড্রো-জিওলজির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ওপর যেকোনো অপরিকল্পিত হস্তক্ষেপ বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। অতীতে এভাবেই অনেক অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ জলাবদ্ধতায় ডুবে গেছে। উল্লেখ্য, সাগর থেকে পানি এসে নয়, বরং নিষ্ককাশনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ায়, বৃষ্টি বা নদীর পানি জমেই সৃষ্টি হয়েছে এসব জলাবদ্ধতা। পরিবর্তিত পরিস্িথতিতে এ ধরনের বেড়িবাঁধ জলাবদ্ধতাকে আরও বাড়িয়ে দেবে।
ভুমির উচ্চতা বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে ব্যবস্থা নিলে: সুপরিকল্পিতভাবে ভুমি ও বন্যাব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উপকুলীয় এলাকায় ভুমির উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা সম্ভব। এ ধরনের ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হবে নদীগুলো যে পলি সাগরে বয়ে নেয়, তার আরও বেশি অংশ ভুমিতে নিয়ে আসা। সংশ্লিষ্ট এলাকায় ছোট ছোট নদী, খাল ইত্যাদির সংস্কার ও নিয়ন্ত্রক বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে প্রয়োজনমতো নদীর পলিসমৃদ্ধ পানি স্থলভাগে প্রবাহিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। পানির স্বাভাবিক নিষ্ককাশনের নিশ্চয়তাসহ, এটি হবে অনেকটা বন্যাকে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করার মতো ব্যবস্থা। এভাবে বন্যা শেষে জমা করা পলি ভুমির উচ্চতা বাড়িয়ে দেবে। উপকুল এলাকাকে অনেক ভাগে বিভক্ত করে, সুবিধামতো এক বা একাধিক অংশে এ উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হতে পারে। কয়েক বছরের মধ্যে এটি উন্নত হলে, অন্য এলাকা এ কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে। দুটি বিষয় এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক হিসেবে দেখা দেবে: ক. বাঁধ নির্মাণ ও নদী সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান। খ. নিয়ন্ত্রিতভাবে ভুমি ব্যবহারের ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি।
আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বাড়লে, বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবে কি যাবে না, সেটা নির্ভর করবে এ দেশের মানুষ ভুমিসম্পদ সংরক্ষণে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার ওপর। কিছুই না করা হলে, প্রকৃতি নিজেই তার সৃষ্ট ভুখন্ড তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষায় কার্যকর ভুমিকা নেবে। সাগরকে ঠেকিয়ে রাখতে ভুল পদ্ধতিতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলে, তা ভুমির তলিয়ে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করবে। ‘ভুমি-নদী-পানির সম্পর্ক’কে বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পিত ব্যবস্থা গড়ে তুললে, ভুমি উন্নয়নের মাধ্যমে এ পরিস্িথতি সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

ড. এম এইচ খান: অধ্যাপক, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বাকৃবি, ময়মনসিংহ।

No comments: