Thursday, December 18, 2008

গুগলের আর একটি অভাবনীয় উদ্ভাবন বাথরুম ইন্টারনেট কানেকশন

প্রকাশ: দৈনিক ইত্তেফাক, আইটি কর্নার, ৭ এপ্রিল ২০০৭

একবার ভাবুন তো, আপনার বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ স্থলটি হল আপনার বাথরুম। খুব অবাক করার মতো হলেও এই অভাবনীয় প্রযুক্তি ব্যবহারে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করবে বিশ্বের সেরা সার্চ ইঞ্জিন প্রতিষ্ঠান গুগল। তাদের এই নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তির নাম হচ্ছে টিআইএসপি বা টয়লেট ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার। গত ১ এপ্রিল গুগল এই সেবা প্রদান শুরু করেছে। বিনামূল্যের এই সেবার আওতায়

ব্যবহারকারীরা পুরো ঘরকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত করতে পারবেন। আর এই সংযোগ স্থাপন হবে ব্যবহারকারীর পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থার সাথে। সংযোগ পেতে কেবলমাত্র গুগলে রেজিস্ট্রেশন করলেই হবে। বাদবাকি কাজ করতে গুগল একটি সেল্ফ ইন্সটলেশন প্যাকেজ পাঠিয়ে দিবে। ইন্টারনেট সংযুক্তির জন্য এখানে কেবল একটি ওয়াইফাই সক্ষম কম্পিউটার ও স্থানীয় মিউনিসিপল পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থার সাথে

সংযুক্ত একটি বাথরুম থাকলেই চলবে। গুগলের কো-ফাউন্ডার এবং প্রেসিডেন্ট ল্যারি পেজ বলেন ‘গুগল এই প্রজেক্টের পেছনে অনেকদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছিল। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য সবগুলো উপায় বের করা যার মাধ্যমে মানুষকে ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত করা সম্ভব। মানুষের ঘরে ঘরে ইন্টারনেট পৌছে দেবার ক্ষেত্রে যে সকল প্রতিকূলতা ছিল তার প্রায় সবগুলোই আমরা উত্তরণের সক্ষম হয়েছি। যারা এই সংযোগের জন্য রেজিস্ট্রেশন করবেন তারা সবাই বাড়িতে একটি সেল্ফ ইন্সটলেশন কিট পাবেন। যেখানে একটি ওয়্যারলেস রাউটার, ফাইবার অপটিক ক্যাবল এবং ইন্সটলেশন সিডি থাকবে। কমোড থেকে ফাইবার অপটিক ক্যাবল সবচেয়ে কাছের টিআইএসপি একসেস মোডে প্লাগইন করতে হবে। এর জন্য কমোড থেকে ক্যাবল প্রবেশ করিয়ে দিলে তা পিএইচডি (প্ল্যাম্বিং হার্ডওয়্যার ডিসপ্যাচার্স) ১ ঘণ্টার মধ্যে ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করবে। ইন্টারনেট সংযোজনের এই অভিনব পদ্ধতি এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র আমেরিকাতে পাওয়া যাচ্ছে। গুগলের ইচ্ছে ভবিষ্যতে এই সুবিধা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দেয়ার।

এম এইচ মিশু

Wednesday, December 17, 2008

‘বাংলাদেশ যুদ্ধের বন্দীরা’: যে যুদ্ধের শেষ নেই

প্রকাশ: দৈনিক প্রথম আলো, বিজয় দিবস বিশেষ সংখ্যা, ১৬-‌১২‌-২০০৮


‘বাংলাদেশ যুদ্ধের বন্দীরা’: যে যুদ্ধের শেষ নেই
ফারুক ওয়াসিফ
যুদ্ধের মধ্যে একজন সৈনিকের সামনে চারটি সম্ভাবনা থাকে: অক্ষত অবস্থায় জয়, আহত হওয়া, রণাঙ্গনে মৃত্যুবরণ এবং যুদ্ধবন্দী হওয়া। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন অনিল আথালে’র ভাগ্যে শেষেরটিই বরাদ্দ ছিল। ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারতের পাঞ্জাব সীমান্তে নিয়তি পাকিস্তানি সৈনিকের চেহারায় এসে তাঁকেসহ তাঁর ছয় সহযোদ্ধাকে বন্দী করে। পরের কাহিনীতে তাই যুদ্ধের উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ নেই। রয়েছে জেল থেকে জেলে আটক থাকার দুঃসহ স্মৃতি।
ভারতের এ রকম আরও দুই হাজার ৩০৭ জন যুদ্ধবন্দী সৈনিকের মধ্যে স্থান হয় তাঁর। এঁদের কেউ কেউ আটক হন বাংলাদেশের রণাঙ্গনে, তবে বেশির ভাগই বন্দী হন ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে।
এর ঠিক ১১ দিন পর পূর্ব রণাঙ্গনে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা ও বেসামরিক নাগরিককে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অস্ত্র সমর্পণ করে যুদ্ধবন্দীর ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়। শুরু হয় দুই হাজার ৩০৭ বনাম ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের কূটনৈতিক খেলা। আর তাতে জড়িত হয়ে যায় বাংলাদেশে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নও। কেননা, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আলাদা একটি যুদ্ধ হলেও বাংলাদেশকে ঘিরে তা হওয়ায় এই যুদ্ধবন্দীদের পরিচয় দাঁড়ায় ‘বাংলাদেশ যুদ্ধের বন্দী’।

বন্দীস্মৃতি
ছয় গুর্খা সৈন্যের সঙ্গে অনিল সীমান্তে টহল দিচ্ছিলেন। হঠাৎ পাকিস্তানি সৈন্যরা সেই এলাকায় আক্রমণ চালায়। বোমা ও গুলির মধ্যে তাঁরা এক পাথুরে এলাকায় আটকে পড়েন এবং বন্দী হন। দুর্ভাগ্যের সেই শুরু। অনিলের কথায়, ‘চূড়ান্ত বিপদ আর চাপের স্মৃতি মানুষ কখনো ভোলে না। এখনো মনে হয় ওসব যেন গতকালের কাহিনী।’
তাঁদের চালান করা হয় রাওয়ালপিন্ডির সেনাসদর দপ্তরে। সেই দলে তিনিই ছিলেন একমাত্র কর্মকর্তা। বাকিরা ‘জওয়ান’। জেরার সময় পাকিস্তানিরা দ্রুতই বুঝে ফেলে এঁর কাছ থেকে কিছু জানা যাবে না। ক্যাপ্টেন অনিলের মতো পদাতিক বাহিনীর লোকদের কাছে আসলে কোনো কৌশলগত নিরাপত্তা তথ্য থাকে না। ‘কেঁচো যেমন তার সামনের মাটিই দেখে, একজন পদাতিকের নজর তেমনি কেবল তার অবস্থানের চারপাশের কয়েক মাইলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ রকম তথ্য শত্রুর কোনো কাজেই লাগে না’।
১৫ দিনের মধ্যেই তাঁকে পাঠানো হয় রাওয়ালপিন্ডি জেলের ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত কক্ষে। বন্দীদের আত্মহত্যা ঠেকাতে সেসব কক্ষের ছাদ রাখা হতো উঁচুতে, ঘরে থাকত না কোনো আসবাব। সেখানে বসে শুনতে পেতেন অন্য কোনো সেল থেকে স্লোগান আসছে, ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’। কারা ওরা? ভারতীয়, বাঙালি? কারা? পরে জানা যায়, ওরা বেলুচ। বাংলাদেশে পাকিস্তানি দখলদারির সময় পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের জনগণও স্বাধিকারের দাবিতে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। বাংলাদেশে যখন গণহত্যা চলছে, তখন খোদ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচ নেতা-কর্মীদের ধরে ধরে জেলে পোরা হচ্ছে।
প্রথম দিকে রাত হলে বিমানের আওয়াজ আসত। পাকিস্তানের আকাশে ভারতীয় বিমান? আশায় রোমাঞ্চিত হয়ে উঠতেন অনিল। তাঁর সেলের ছাদেই বিমানবিধ্বংসী বন্দুক বসানো। অনিলের আশা সেখানে বোমা পড়লেই তিনি পালাবেন। তাই বিমানের আওয়াজ পাওয়ামাত্রই বুট পরে বসে থাকতেন।
একদিন আর বিমানের আওয়াজ এল না। কয়েক দিন সব চুপচাপ। তারপর আগমন ঘটল এক মেজরের। রাতের পর রাত না ঘুমানোর ছাপ তাঁর চোখে-মুখে। তিনি অনিলকে জিজ্ঞেস করেন, ‘রাওয়ালপিন্ডি শহর দেখেছ?’ দেখার তো উপায় ছিল না। জেলে আনার পথে অনিলদের তো চোখ ছিল বাঁধা। উত্তর না আসায় খেপে গিয়ে মেজর বলেন, ‘চিন্তা কোরো না, একদিন এখানে বিজয়ীর বেশে তোমরা আসবে। তখন মন ভরে দেখো।’
বিদ্যুৎ চমকে গেলে অনিলের মনে। যুদ্ধ শেষ? পাকিস্তান পরাজিত হয়েছে! মুক্তি কি আসন্ন?
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষাশেষি কোনো এক দিন। জেলের বাইরে দিয়ে বিরাট এক মিছিলের আওয়াজ আসে। তারা স্লোগান দিচ্ছে, ‘ভুট্টো জিন্দাবাদ’। ঘণ্টাখানেক পর সেই মিছিল ফিরে আসে নতুন স্লোগান নিয়ে, ‘হামারা নয়া সর্দার ভুট্টো জিন্দাবাদ’। সেই রাতেই জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট হন। কিন্তু অনিল জানতেন না, আরও কয়েক বছর পর তাঁর আশপাশের কোনো সেলেই ভুট্টো পার্শ্ববর্তী প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ থেকে বন্দী হয়ে আসবেন। এবং তারও কিছুদিন পর সেখানেই তাঁকে ফাঁসি দেবেন আরেক জেনারেল জিয়াউল হক।
বাহাত্তর সালের ফেব্রুয়ারি মাস। অনিলদের সরিয়ে নেওয়া হয় লায়ালপুরে (তৎকালীন ফয়সালাবাদ জেল) যুদ্ধবন্দীদের জন্য নির্ধারিত শিবিরে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শেষ হলেও উভয় দেশের যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির মুহূর্ত আর আসে না। বাংলাদেশ কোনোভাবেই যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্ণিত করে বিচার শুরু না করে বিষয়টির ফয়সালা করতে রাজি নয়। এভাবে শুরু হয় উভয় দেশের যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির কূটনৈতিক যুদ্ধ।

লায়ালপুরের জীবন
লায়ালপুর যুদ্ধবন্দী শিবিরের দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ লতিফ মালিক। একদিন তিনি কয়েকজন বন্দী ভারতীয় কর্মকর্তাকে শিবিরটি ঘুরে দেখান। সেটা এক মারাত্মক জেলখানা। পরপর ১০ ফুট উঁচু তিনটি দেয়ালের চক্কর দিয়ে ঘেরা। জায়গায় জায়গায় ওয়াচপোস্টে মেশিনগানধারী প্রহরী, সার্চলাইট ও শিকারি কুকুর। ওই চিত্র যে দেখেছে, পালানোর সাধ তার উবে যাবে। কর্নেল লতিফ তাই ঠাট্টার সুরে বলতে পারেন, ‘তোমাদের পালানোর অধিকার রয়েছে, যেমন আমাদেরও অধিকার রয়েছে ধরা পড়লে গুলি করে মারার।’ সেখানেই বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের ঘৃণার মাত্রাটা বুঝতে পারা যায়। এক পাকিস্তানি কর্মকর্তা তো বলেই ফেলে, ‘পাকিস্তানি সৈন্যরা যে বাংলাদেশের বদলে ভারতের হাতে বন্দী এতে আমরা খুশি।’ বাংলাদেশ নাকি তাদের জন্য বোঝা ছিল। বোঝা নেমে যাওয়ায় এখন তারা নাকি খুশি।

সিমলা চুক্তি
দেখতে দেখতে চলে আসে বাহাত্তর সালের জুলাই মাস। খবর আসে ইন্দিরা গান্ধী ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে সিমলা চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। তার মানে মুক্তি?
কিন্তু আশার ফুলে তখনো কাঁটা ছিল। বাংলাদেশ যুুদ্ধবন্দীদের মধ্যে চিহ্ণিত ২০০ যুদ্ধবন্দীর মুক্তির বিষয়টি মানতে নারাজ। ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল এ বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি সমঝোতাও স্বাক্ষরিত হয়। যাহোক, একসময় বিষয়টির আপাত সমাধানও হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো একতরফাভাবে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেন। বিনিময়ে ভারতও ঘোষণা দেয় যে এ মুহূর্তে কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের রণাঙ্গনে আটক হওয়া পাকিস্তানি সৈন্যদের মুক্তি দেওয়া হবে। অনিলদের ভাগ্যের সুখপাখি সেদিনই ডানা মেলল। তাঁরা মুক্ত হলেন। তারিখ ১ ডিসেম্বর ১৯৭২।
কিন্তু বাংলাদেশে আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের মুক্তি পেতে লেগে যায় আরও তিনটি বছর। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি ও প্রত্যাবর্তন বিষয়ে দিল্লিতে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয় ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল। সেই চুক্তির বলে ১৪ নভেম্বর তারা মুক্ত হয়। তাদের মধ্যে ছিল কয়েক শ বাঙালি রাজাকারও।

যে যুদ্ধের শেষ নেই
একাত্তরের যুদ্ধবন্দীদের কথা সবাই যখন ভুলতে বসেছে, তখন হঠাৎ সামনে চলে আসে নাসিরের কথা। তাঁর আদি নিবাস ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের গাজিপুরে। একাত্তরের বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটক হন পাকিস্তানি নাগরিক নাসির উদ্দীন। স্বাধীনতার পর তাঁকে হস্তান্তর করা হয় ভারতীয়দের হাতে। তারপর বহুবছর কেউ তাঁর খোঁজ করেনি। যেন নাসির নামে কেউ কখনো ছিল না। কিন্তু ২০০৮ সালে কলকাতার আলিপুর জেল থেকে ছাড়া পাওয়া এক কয়েদি পুরোনো ইতিহাস ধরে টান দেন। মুক্তি পেয়েই তিনি গাজিপুরে নাসিরের আত্মীয়দের কাছে খবর পাঠান: নাসির বেঁচে আছে, ২০০০ সালে তাঁকে শেষ দেখা গেছে আলিপুর জেলে। খবর যায় করাচিতে বসবাসরত নাসিরের ছেলে হোসাইনের কাছে।
হোসাইনরা মেনে নিয়েছিল যে তাদের বাবা মারা গেছেন। কিন্তু নতুন খবরে আবার শুরু হলো তাদের দহন। কীভাবে তারা ফিরে পাবে ৩৭ বছর আগের যুদ্ধবন্দী নাসিরকে? একই প্রশ্ন ভারতের সুমন পুরোহিতের, ‘আমার বিয়ের ১৮ মাস পরে, আমার ছেলে বিপুলের জন্নের তিন মাসের মাথায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের পঞ্চম দিনে আমার স্বামী বিমান নিয়ে পাকিস্তানে হামলা চালাতে গিয়ে নিখোঁজ হন।’ তখন সুমনের বয়স ছিল ২৩ বছর, এখন ৫৯। ৩৭ বছর ধরে তিনি খুঁজে চলেছেন তাঁর স্বামীর সন্ধান। নানান সময়ে খবর আসে, কেউ নাকি তাঁকে দেখেছে পাকিস্তানের কারাগারে। বিভিন্ন বইপত্রেও এ রকম ইঙ্গিত মেলে। এ রকম আরও ৫৪ জন নিখোঁজ ভারতীয় সৈনিকের পরিবারের সদস্যরা এখানে-ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছে−যদি স্বজনের খোঁজ মেলে, যদি তার দেখা মেলে!
এই খোঁজাখুঁজির দৌড়ে ছুটতে ছুটতে ওই ৫৪ জনের পরিবার মিলে একটি সংগঠনও বানিয়েছে। তাদের কাজ নিখোঁজ যুদ্ধবন্দীদের হদিস বের করা এবং তাদের মুক্ত করার জন্য তদবির করা। পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলেও তারা ঘুরে বেড়িয়েছে।
তিনটি জেলে খোঁজা শেষ করে বৃদ্ধ সুমন এখন তরুণী বয়সে হারানো তাঁর তরুণ স্বামীকে খঁুজতে যাবেন লাহোর জেলে। সেখানে না পেলে রাওয়ালপিন্ডি অথবা লায়ালপুরে অথবা অন্য কোথাও। ‘আমি খুঁজবই। খঁুজে না পেয়ে জেল গেট দিয়ে হেঁটে বের হয়ে আসা অসহ্য লাগে। মনে হয় আর পারব না, কিন্তু আশা আমাকে পাথরের মতো শক্ত করেছে।’
ওদিকে পাকিস্তানের করাচি থেকে নাসিরের ছেলে হোসাইনও কলকাতায় আসছে তার বাবাকে খঁুজে বের করতে। এ রকম কত হোসাইন আর কত সুমন বুকে পাথর বেঁধে ছুটে বেড়াচ্ছে কোনো বিস্মৃত যুদ্ধবন্দীকে মুক্ত করার জন্য। সেই ছোটাছুটির মধ্যে কোনো জেলে বা কোনো সীমান্তে একদিন হয়তো তাদের দেখাও হয়ে যাবে। সেই দেখাদেখির মধ্যে কোনো শত্রুতা থাকবে কি? যে যুদ্ধের বন্দী তাদের বাবা ও স্বামী, সেই যুদ্ধ তো অনেক আগেই শেষ। কিন্তু তাদের লড়াই বুঝিবা এখনো শেষ হয়নি। তাদের আত্মীয়রা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে বন্দী হয়েছিল। কিন্তু আপনজনকে মুক্ত করার লড়াইয়ে আজ তারা এক। সেই লড়াইয়ে তারা আর ভারতীয় বা পাকিস্তানি নয়; তারা সহযোদ্ধা। তারা যুদ্ধবন্দীদের স্বজন। অন্যদিকে কোনো এক অজ্ঞাত কারাকক্ষে কোনো একজন পুরোহিত বা নাসির অপেক্ষা করেন−একদিন ডাক আসবে মুক্তির। দেয়ালের গায়ে দাগ কেটে কেটে তাঁরা হয়তো বছর পেরোনোর হিসাব রাখেন। কত বছর পেরোল? দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে তাঁরা গোনা শেষ করেন: ৩৭ বছর!

রশীদ তালুকদারের ছবির কথা

প্রকাশ: দৈনিক প্রথম আলো, বিজয় দিবস বিশেষ সংখ্যা, ১৬-‌১২‌-২০০৮

একাত্তরের রণাঙ্গনে একজন বিহারি মুক্তিযোদ্ধা: সুবেদার সৈয়দ খান বীর প্রতীক


প্রকাশ: দৈনিক প্রথম আলো, বিজয় দিবস বিশেষ সংখ্যা, ১৬-‌১২‌-২০০৮



একাত্তরে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন আমি ইপিআর বাহিনীতে কর্মরত ছিলাম। আমার কোম্পানি তখন কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ছিল। ২৬ মার্চ আমার কোম্পানির সদস্যরা ক্যাপ্টেন নওয়াজীর নেতৃত্বে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। সে সময় অবাঙালি হিসেবে সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছিল। অর্থাৎ আমি এখন কী করব। কেউ কেউ আমাকে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু আমার মধ্যে এ দেশের মায়া খুবই কাজ করতে থাকে। আমি আমার কোম্পানির অন্য সদস্যদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। আমাদের কোম্পানি কাউনিয়া ব্রিজের অপর প্রান্তে অবস্থান নেয়। সে সময় কাউনিয়ায় জিআরপি থানা ছিল। সেখানে পাকিস্তানিরা ছিল। আমরা প্রথমে তাদেরই টার্গেট করি। ২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে আমরা ব্রিজের অপর প্রান্তে অবস্থান নিয়েছিলাম, ওরা বুঝতে পারেনি। এ সময় এক পাকিস্তানি মেজর ও তিনজন সিপাহি এবং একজন বাঙালি ওসি ব্রিজ পার হয়ে আমাদের অবস্থানের দিকে আসছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাঙালি অফিসারটিই সামনে ছিলেন। সে সময় ব্রাশ ফায়ার করা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু তা করলে বাঙালি অফিসারটির বাঁচার কোনো উপায় নেই। এদিকে তাঁকে রক্ষার জন্য যদি আক্রমণ না করি, তাহলে তারা আমাদের অবস্থানের খবর পেয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, দেশের স্বার্থে হতভাগ্য বাঙালি অফিসারটির জীবন অবসানই মঙ্গলজনক। ব্রাশ ফায়ারের দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকেই। পাক জোয়ানদের সঙ্গেই মারা পড়লেন বাঙালি অফিসারটিও। কাউনিয়া ব্রিজের অপারেশন দিয়েই শুরু হলো আমাদের যুদ্ধ।
এর পরই পাকবাহিনীর লোকেরা টের পেয়ে যায় যে তাদের খুব কাছেই আমরা অবস্থান নিয়ে আছি। তারা গুলি চালাতে শুরু করল। আমরাও এবার থেকে প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে গেলাম। পাকসেনারা খুব চেষ্টা করে ব্রিজ পার হওয়ার জন্য, কিন্তু কিছুতেই আমরা সে সুযোগ দিয়নি। সেদিন এই ব্রিজ পার হওয়া পাকবাহিনীর জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রথম সম্মুখযুদ্ধে আমরা তাদের সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হই।
এদিকে পাকবাহিনী কিছুতেই ব্রিজ পার না হতে পেরে বিকল্প বুদ্ধি অাঁটে। তারা প্লেনে করে আমাদের তিন-চার কিলোমিটার পেছনে মহেন্দ্রনগরে আসে। আমরা গোপন সূত্রে সে খবর পেয়ে যাই যে পাকসেনারা পেছন দিক থেকে আমাদের আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছে। সে সময় আমরা দ্রুত সেখান থেকে রাজাহাট হয়ে কুড়িগ্রাম চলে আসি। এ সময় আমাদের কোম্পানিতে ইপিআর ও কিছু মুক্তিসেনা মিলে প্রায় ৬০ জন সদস্য ছিল।
কুড়িগ্রামে তিন জায়গায় আমরা ডিফেন্স নিই। তিন জায়গাতেই লড়াই হয়। পাকসেনারা তাদের অবস্থান ছেড়ে চলে যায়। পরের দিন আবার এসে আক্রমণ চালায়। সেখানে এভাবে আমরা তাদের মোকাবিলা করতে পারছিলাম না। আমাদের কাছে ভারী কোনো অস্ত্র ছিল না। বাধ্য হয়ে আমরা নদী পার হয়ে পাটেশ্বরী চলে এলাম। এর পর ভূরুঙ্গামারী হাইস্কুল ক্যাম্পে এসে উঠি। সেখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা। সেখান আমাদের সঙ্গে একপর্যায়ে এক কোম্পানি ভারতীয় সেনা এসে যোগ দেয়। আমরা খবর পাই হাতিবান্ধা থানায় পাঞ্জাবিরা ডিফেন্স নিয়ে আছে। আমি ৪০ জন সেনাসদস্য নিয়ে ফায়ার করতে করতে এগোতে থাকি। একই সঙ্গে ভারতীয় সেনারা ওপর থেকে সিলিং করতে থাকে। আমরা যখন শত্রুদের কাছাকাছি চলে যাই, ভারতীয় সেনারা সিলিং বন্ধ করে এবং আমরা ফায়ার শুরু করি। এ সময় পাঞ্জাবিরা সিলিং শুরু করে দিল। এতে আমাদের বরিশালের একজন নায়েক সুবেদার সেখানে শহীদ হন। একপর্যায়ে পাঞ্জাবিরা পাশের একটা নালা ধরে পেছনে সরে যায়। ওই অপারেশনে কোনো পাঞ্জাবি মারা গেছে কি না, আমরা জানতে পারিনি। কিন্তু পরে আমরা সেখানে গিয়ে অনেক রক্ত দেখতে পেয়েছি। আমাদের ধারণা, সেখানে অনেক হতাহত হয়েছে। তারা তাদের (আহত-নিহত) সরিয়ে নিয়ে যায়।
আমরা রংপুরের হারাগাছা এলাকায় থাকতেই দেশ স্বাধীন হয়। দুটি অপারেশনে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য আমাকে বীর প্রতীক খেতাব দেওয়া হয়।
বি. দ্র. সৈয়দ খানের বয়স এখন প্রায় ৮২। এখন তিনি অনেক কিছুই ঠিকমতো মনে করতে পারেন না। গুছিয়ে বলতেও পারেন না। তাছাড়া যুদ্ধের পর তাঁর ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর স্ত্রী ও সন্তানসন্ততিদের হত্যা করেছিল। তিনি যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে পরিবারের আর কাউকে পাননি। এ অবস্থায় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে বিয়ে দেওয়া হলেও আর্থিক অনটনের কারণে সেই স্ত্রীও তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে তাঁর কাছ থেকে চলে গেছেন। এখন তিনি পরিণত বয়সে একেবারে অসহায় অবস্থায় অন্যের আশ্রয়ে রয়েছেন। এ অবস্থায় তাঁর স্মৃতি থেকে যতটুকু উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, তা পত্রস্থ করা হলো।
অনুলিখন: আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী অফিস

জেনারেল জ্যাকবের বিশেষ সাক্ষাৎকার: ‘মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকাই বড় ছিল’


প্রকাশ: দৈনিক প্রথম আলো, বিজয় দিবস বিশেষ সংখ্যা, ১৬-‌১২‌-২০০৮





লে. জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব। বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে ঘনিষ্ঠ একটি নাম। তাঁর স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবন কেটেছে পর্যায়ক্রমে দার্জিলিং ও কলকাতায়। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে স্মাতক ডিগ্রি নিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৪১ সালে। তখন বয়স ১৮। জন্নসূত্রে ইহুদি। সরকারি নথিতে তাঁর জন্ন তারিখ ২ মে ১৯২১। চিরকুমার। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামকালে তিনি ভারতের সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব জেনারেল স্টাফ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য পিভিএসএম (পরম বিশিষ্ট সেবা মেডেল) খেতাবে ভূষিত হন। ১৯৭৮ সালের জুলাইয়ে তিনি অবসর নেন। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা, বার্থ অব এ নেশন। ২৮-২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৮ সালে এই অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয় দিল্লিতে তাঁর আর কে পুরামের ফ্ল্যাটে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক মিজানুর রহমান খান।

প্রথম আলো: আপনার নামের আগে জেএফআর শব্দটি দেখছি। নামকরণের গল্প বলুন।
জ্যাকব: পুরো নাম জ্যাকব ফ্রেডারিক রালফ জ্যাকব। কর্মক্ষেত্রে আমার উপনাম ছিল ‘জেক’। আরবি জানা মা আমাকে একটি আরবি উপনামেও ডাকতেন। ‘ফারাজ’। এর অর্থ সুখ। তৃতীয় নাম রালফ বা রাফায়েল, এটি বাইবেলের একটি নাম।
প্রথম আলো: আপনার পূর্বপুরুষেরা কোথাকার?
জ্যাকব: ২০০ বছর আগে বর্তমান ইরাক বা সিরিয়ার কোনো অঞ্চল থেকে আমার পূর্বপুরুষেরা ভারতবর্ষে আসেন।
প্রথম আলো: ঠিক কোন এলাকা থেকে?
জ্যাকব: আমরা বাগদাদ থেকে এসেছি। পূর্বপুরুষেরা বিশুদ্ধ ইহুদি ছিলেন।
প্রথম আলো: ইসরায়েলের হারিয়ে যাওয়া ১০টি গোত্রের (বাইবেলে বর্ণিত টেন মিসিং-ট্রাইবস) একটি উত্তর-পূর্ব ভারতে রয়েছে বলে একটি দাবি করা হয়। আপনি কি তা বিশ্বাস করেন?
জ্যাকব: এ নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক আলাপ-আলোচনা আছে। আমি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই। এর উত্তর আমার জানা নেই।
প্রথম আলো: ১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণে গিয়ে আপনি চিতাবাঘের দাঁত নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন। বাঘ-বৃত্তান্ত বলুন।
জ্যাকব: বহু বছর আগে আমি দিল্লিতে কুতুবমিনারের কাছাকাছি একটি রেঞ্জে ট্রেনিংয়ে ছিলাম। একদিন শুনলাম একটি চিতাবাঘ গ্রামবাসীকে বড় ভোগাচ্ছে। প্রায়ই ছাগল ধরে নিচ্ছে। আমি খুব কাছ থেকে চিতাবাঘটিকে শিকার করেছিলাম। বিমানে বহনকালে ওই চিতাটির একটি দাঁত খসে পড়ে। আমি দন্ত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। চিকিৎসক প্রথমে অপমানিত বোধ করেছিলেন। পরে উপযুক্ত সম্মানীর বিনিময়ে তিনি তা মেরামত করেন।
প্রথম আলো: ইহুদি ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির মধ্যে কি কোনো মিল খঁুজে পান? আপনার তো পড়াশোনা রয়েছে।
জ্যাকব: আমি বিশেষজ্ঞ নই। বড় যে ধার্মিক, তাও নই। চোখ জুড়ানো নৈসর্গিক সৌন্দর্যখচিত লাদাখে আমি বহু মঠ ঘুরেছি। সব ধর্মের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রয়েছে।
প্রথম আলো: ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো। আপনার বিবরণমতে কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে জেনারেল স্যাম মানেকশ ইন্দিরাকে রাজি করালেন যে এপ্রিলের মধ্যেই বাংলাদেশে ভারতীয় অভিযান পরিচালিত হওয়া উচিত। আপনি বেঁকে বসলেন। বললেন, ১৫ নভেম্বরের আগে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। এতে তিনি ‘হতাশ ও অধৈর্য’ হলেন।
জ্যাকব: প্রত্যেক ব্যক্তির কিন্তু নিজস্ব ধ্যান-ধারণা থাকবেই।
প্রথম আলো: কিন্তু আপনার বইয়ে যুদ্ধ পরিকল্পনায় মানেকশর সামগ্রিক ভূমিকা কিন্তু ধূসর। ফোর্ট উইলিয়ামে একাত্তরের আগস্ট বৈঠকে মানেকশ বললেন, খুলনা ও চট্টগ্রাম দখল করতে পারলেই যুদ্ধ শেষ হবে। এমনকি আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরদাতা লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাও ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এই মত পোষণ করেন। আপনি ছাড়া ঢাকার পতন চিন্তা কারও মাথায় ছিল না। তাহলে কি বলা যায়, একজন জ্যাকব না হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত?
জ্যাকব: আমি এভাবে দেখি না। মানেকশর ছিল একটি দৃষ্টিভঙ্গি, আমার ভিন্ন। হয়তো তিনিও সঠিক বলে প্রমাণিত হতে পারতেন, আমি তা জানি না। তিনি আমার বস ছিলেন। তাঁর নির্দেশ মেনে চলাই ছিল আমার কাজ। আমি একজন ভালো সৈনিক ছিলাম। তা ছাড়া দুজন একই ভাবনা ভাবতে পারেন না।
প্রথম আলো: ভারত সরকারের তরফে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য ও সহযোগিতা দেওয়ার বিষয়ে আপনি লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজির পিআরও সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ থেকে তথ্য ধার করেছেন। সালিক লিখেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি পর্যায়ে সহযোগিতা দেওয়া হয়। এটা কি সঠিক?
জ্যাকব: মোটামুটি এটাই সত্য। সালিক জানতেন কী ঘটেছিল।
প্রথম আলো: নিজের ঘরের তথ্য দিতে নির্ভর করলেন অন্যের ওপর। কেন?
জ্যাকব: আমাকে এটা স্পষ্ট করতে দিন যে ভারত সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়টি এখনো ক্লাসিফায়েড (গোপনীয়) হিসেবে বিবেচিত। সে কারণেই আমি অন্যের ওপর নির্ভর করেছি।
প্রথম আলো: সালিকের মতে বাংলাদেশের এক লাখ গেরিলাকে প্রশিক্ষণ দিতে ভারত প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করেছিল। কনভেনশনাল বা প্রথাগত যুদ্ধের জন্য ৩০ হাজার এবং গেরিলা কৌশল অবলম্বনের জন্য ৭০ হাজারকে প্রস্তুত করা হয়। এই তথ্য সঠিক?
জ্যাকব: শতভাগ না হলেও সাধারণভাবে সঠিক বলতে পারেন।
প্রথম আলো: আপনি লিখেছেন, মুক্তিযোদ্ধারা একটি বাদে সব ম্যাপ জোগাড় করতে পেরেছিল। তাতে কি সমস্যা হয়েছিল?
জ্যাকব: আমাদের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের কোনো ম্যাপই ছিল না। যে ম্যাপ ছিল তা ৫০ বছরের পুরোনো। ম্যাপ ছাড়া কীভাবে কী করব, তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তখন এম এ জলিলসহ অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারের কাছে ম্যাপের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করলাম। তাঁরা দ্রুত সংগ্রহ করলেন। শুধু বগুড়া বা অন্য কোনো একটি এলাকার ম্যাপ পাওয়া গেল না, কিন্তু তাতে অসুবিধা হয়নি। আমরা পুরো যুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের তৈরি করা ম্যাপই ব্যবহার করি।
প্রথম আলো: মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে আপনার বৈঠকের বিষয়ে কিছু বলবেন কি?
জ্যাকব: অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের সঙ্গে আমার বৈঠক হতো। সরকার হয়তো একদিন এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করবে।
প্রথম আলো: পাকিস্তানি বাহিনীর সাঙ্কেতিক বা ওয়্যারলেস বার্তা ধরার ব্যাপারে আপনাদের সাফল্য কেমন ছিল?
জ্যাকব: এ কাজে খুবই সফল ছিলাম। আমরা তাদের গুপ্ত বার্তার অনেকটাই ধরে ফেলতাম। এ বিভাগটি সরাসরি আমার অধীনে ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে আমরা আগাম ধারণা পেতাম। অনেক আক্রমণ ডিকোডিংয়ের ভিত্তিতে হয়েছে। সাগরে সাবমেরিন ‘গাজি’র উপস্থিতি আমরা আগেই টের পাই। একে সহজেই উড়িয়ে দেওয়া হয়।
প্রথম আলো: মার্কিন সপ্তম নৌবহর কি সত্যি মার্কিন নাগরিকদের নিতে এসেছিল?
জ্যাকব: এটা খুবই বিতর্কিত। আমি তো আত্মসমর্পণ নিয়ে ১৩-১৪ ডিসেম্বরে নিয়াজির সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। আমরা বিদেশি নাগরিক বহনে জাতিসংঘের একটিসহ চারটি বিমান অবতরণের অনুমতি দিই। ১১ ডিসেম্বর তারা চলে যায়। সুতরাং এরপর মার্কিন নাগরিকদের বহনের কথা বলে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর তো যুক্তি নেই। ওটা ছিল ‘শো অব ফোর্স’।
প্রথম আলো: আপনার বইয়ে একাত্তরের ওয়ার থিয়েটারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। এটা কি মুক্তিযুদ্ধের ওপর সামগ্রিকভাবে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল?
জ্যাকব: অবশ্যই ফেলেছিল। অনেকের সঙ্গেই ব্যক্তিগত সম্পর্কের খুব টানাপোড়েন যাচ্ছিল। একজনের সঙ্গে আরেকজনের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ ছিল। সৌভাগ্যবশত তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আমার সম্পর্ক ছিল ভালো।
প্রথম আলো: ঢাকা অভিযানের পরিকল্পনা দয়া করে খুলে বলবেন কি?
জ্যাকব: ভারতের সেনা সদর দপ্তর ঢাকার জন্য কোনো সেনা বরাদ্দ করেনি। কারণ, ঢাকা দখলের কোনো চিন্তাই তাঁদের ছিল না। আমি আমার লক্ষ্য অর্জনে বেছে নিই টাঙ্গাইলকে। কারণ ছিল মূলত তিনটি। প্রথমত, টাইগার সিদ্দিকীর সাহায্য পাব। তাঁর অধীনে ২০ হাজার সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তিনি তাঁর বাহিনী দিয়ে আমাদের ছত্রিসেনাদের সুরক্ষা দেবে। দ্বিতীয়ত, জায়গাটা সীমান্ত থেকে খুব দূরেও নয়। তৃতীয়ত, ঢাকার সঙ্গেও যুদ্ধের দূরত্ব বেশি নয়। আমরা উত্তর দিক থেকে ঢাকা আক্রমণের পরিকল্পনা করি। আমরা আশা করি, সিদ্দিকী আমাদের সঙ্গে ঢাকামুখী মার্চে অংশ নেবেন। ছত্রিসেনা পাঠানোর আগে আমি ক্যাপ্টেন পি কে ঘোষকে পাঠাই সিদ্দিকীকে ব্রিফ করতে। তাঁকে ঢাকা অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলি, যাতে তিনি ঢাকায় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে পূর্ণ বিদ্রোহ নিশ্চিত করতে পারেন। নভেম্বরে সিদ্দিকীকে এই বার্তা দেওয়া হয়। সিদ্দিকী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। যুদ্ধ বেধে গেলে তিনি কথা অনুযায়ী ছত্রিসেনা অবতরণে সহায়তা দেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী প্রত্যাহার শুরু করলে তিনি আক্রমণ থেকে বিরত ছিলেন।
প্রথম আলো: সিদ্দিকী বাহিনীর এত অস্ত্রশস্ত্রের জোগান আপনারাই দিয়েছিলেন? কী ধরনের অস্ত্র ছিল?
জ্যাকব: পুরো অস্ত্র আমরাই দিই। রাইফেল, এলএমজি, গ্রেনেড, বিস্কোরক ছিল।
প্রথম আলো: সিদ্দিকীর ওই সিদ্ধান্ত কি সুচিন্তিত ছিল?
জ্যাকব: আমি জানি না। তাঁকেই জিজ্ঞেস করে জানুন, পাকিস্তানিরা যখন সরে যাচ্ছিল, তখন তিনি কী করেছিলেন? আর কেন তিনি ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে ঢাকায় মুভ করেননি? যুদ্ধবিরতির পরেই কেবল তিনি তাঁর কিছু সেনা ঢাকায় পাঠান। আমি তাঁকে ১৬ ডিসেম্বরে ঢাকায় দেখি। না, আমি কোনো বিতর্কে যেতে চাই না। তিনি আপনাদের জাতীয় বীর। আমি ইতিহাসের বিবরণ দিচ্ছি মাত্র। টাঙ্গাইলে যখন ছত্রিসেনা নামল, তখন তিনি ভালো ভূমিকা রাখলেন। তাঁদের নিরাপত্তা তাঁরই দেওয়ার কথা ছিল; কিন্তু তিনি সেনাদের সঙ্গে ঢাকায় মুভ করেননি। আমি সিদ্দিকীকে বুঝতে পারিনি। তিনি নিশ্চয় মহান সৈনিক।
প্রথম আলো: মস্কোপন্থি ডিপি ধর একাত্তরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান। আত্মসমর্পণের কয়েক দিন পরই আপনি তাঁকে বলেছিলেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা, ছিটমহলগুলোর যথাযথ বিন্যাস এবং চট্টগ্রাম বন্দরসহ রেল ও নৌ ট্রানজিট বিষয়ে চুক্তি করতে। তাঁকে সতর্কও করেছিলেন যে এটা এখনই না করলে ভবিষ্যতে করা খুবই দুরূহ হবে। কীভাবে এমন দূরদর্শী হতে পারলেন?
জ্যাকব: আমি বাস্তবতার নিরিখেই কথাটা বলেছিলাম। সীমান্তের মানুষের জন্য ছিটমহলের ফাঁড়া বহুদিনের। আর ট্রানজিট তো একপক্ষীয় নয়, এটা বহুমুখী হতে পারে। বাংলাদেশ ভারতের ভূখণ্ড দিয়ে নেপাল যেতে পারে। ডিপি ধর কিন্তু আমার সঙ্গে একমত হননি।
প্রথম আলো: নক্সালবাড়ি আন্দোলন কি কোনোভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রভাব রেখেছিল?
জ্যাকব: চারু মজুমদারের সেই আন্দোলন দমনে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৯−১৯৭২ পর্যন্ত আমি ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ছিলাম। এ সময় তাদের দমনে পরিচালিত বিশেষ অভিযানের দায়িত্ব আমিই পালন করছিলাম। সরকার এ জন্য আমাকে পশ্চিমবঙ্গে দুই আর্মি ডিভিশন এবং ৫০ প্যারাস্যুট ব্রিগেড মোতায়েনের অনুমতি দেয়। পরে তাদের যুদ্ধের কাজে লাগে। সৌভাগ্যবশত একাত্তরের পরিস্থিতির কাছাকাছি সময়ে ওই অভিযান শেষ করতে পেরেছিলাম। এর উল্লেখ আমার বইয়ে নেই।
প্রথম আলো: যুদ্ধকালে ভারত কি সোভিয়েত ইউনিয়ন বা অন্য কোনো মিত্র দেশ থেকে অস্ত্র সহায়তা পেয়েছিল?
জ্যাকব: না। আমরা পাইনি। স্থানীয়ভাবে যা উৎপাদিত হয়েছে, তা-ই ব্যবহার করা হয়।
প্রথম আলো: গওহর আইয়ুব দাবি করেছেন যে মানেকশ পঁয়ষট্টির যুদ্ধের ভারতীয় সামরিক পরিকল্পনা পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করেছিলেন?
জ্যাকব: গওহর যখন এই দাবি করেন, তখন মানেকশ খুবই অসুস্থ, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মানেকশ একজন সম্মানিত ব্যক্তি। আমি মনে করি না যে এটা আদৌ সত্য। এর কোনো ভিত্তি নেই।
প্রথম আলো: আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে একমাত্র নারী ছিলেন অরোরার স্ত্রী ভান্তি অরোরা। সত্যি?
জ্যাকব: সত্যি। আমার কাছে তাঁর ফটো রয়েছে। তিনি মারা গেছেন।
প্রথম আলো: মুক্তিযুদ্ধের কোন স্মৃতি আপনাকে তাড়া করে ফেরে?
জ্যাকব: তাজউদ্দীন আহমদ একজন ব্রিটিশ এমপির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন। সীমান্তের কাছাকাছি একটি স্থানে বৈঠক বসল। কিন্তু দ্রুত বিপদ টের পেলাম। গোলাগুলি চলল। বললাম, প্রধানমন্ত্রী জলদি করুন। কারণ, পাকিস্তানি সেনারা খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে এখন। আমরা তাঁদের নিরাপত্তায় আমাদের সীমান্তে সেনা মোতায়েন করেছিলাম। সেদিন চেকপয়েন্টের মাস্টে আমার তদারকিতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ল। সে পতাকা আর নামেনি। এ স্মৃতি আমাকে মাঝেমধ্যে আবেগাপ্লুত করে।
প্রথম আলো: আপনার সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের অভিজ্ঞতা কেমন হলো।
জ্যাকব: আমি আনন্দিত যে বাংলাদেশের বর্তমান সেনাবাহিনী দারুণভাবে পেশাদারিত্ব ও দক্ষতা অর্জন করেছে। আমি সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ ও অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঢাকায় খুব ভালো সময় কাটিয়েছি। আপনাদের সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলাবোধ দেখে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ।
প্রথম আলো: আপনার এই ধারণা কি নতুন?
জ্যাকব: বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে আগে এমন প্রত্যক্ষভাবে তো আমি জানতাম না। কিন্তু সফরকালে আমি ভীষণ সন্তুষ্ট হলাম। হাইলি প্রফেশনাল আর্মি। খুবই ভালো প্রশিক্ষিত। খুবই ভালো শৃঙ্খলাপরায়ণ। আমার অন্তরের সবটুকু উষ্ণতা দিয়ে তাদের জানাই অভিনন্দন। সেনাবাহিনীর আতিথেয়তা আমাকে আনন্দে উদ্বেলিত করেছে। সেনাপ্রধান খুবই চমৎকার মানুষ। আমি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অব্যাহত ভালো সম্পর্ক দেখতে চাই। দুই দেশের অবশ্যই উচিত হবে একত্রে কাজ করা। সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে। উভয়ের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। উভয় দেশেই রয়েছে যথেষ্ট দারিদ্র্য। আমাদের অভিন্ন সমস্যা রয়েছে।
ভুলবেন না যেন আমি বাংলাদেশের একজন মহান বন্ধু। বাংলাদেশের ভীষণ অনুরাগী। দয়া করে আমার বরাতে এমন কিছুই লিখবেন না, যাতে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে আমার সম্পর্কে কোনো চিড় ধরে। বাংলাদেশের জনগণ আমার একান্ত আপনজন। আমি তাদের ভালোবাসি। ঢাকা সফরকালে মুক্তিযোদ্ধারা পরম মমতায় আমাকে আলিঙ্গন করেছেন। আমি জনগণের ভালোবাসায় একেবারে সিক্ত হয়ে ফিরেছি।
প্রথম আলো: পেশাদারির বিবেচনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোনো তুলনা করবেন কি?
জ্যাকব: না। আমি তো দীর্ঘদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পর্কে কিছুই জানি না।
প্রথম আলো: মুক্তিযুদ্ধের মুখ্য ব্যক্তিত্বের মধ্যে হাতে গোনা যে কজন বেঁচে আছেন, আপনি তাঁদের একজন।
জ্যাকব: আমি জানি না, আমি মুখ্য ব্যক্তিদের একজন কি না। আমি আমার কাজ করেছি। কাজটা পছন্দের ছিল। সৈনিকের কর্তব্য পালন করেছি মাত্র।
প্রথম আলো: আর এটাই আপনার সামরিক জীবনের শ্রেষ্ঠতম সাফল্য।
জ্যাকব: হ্যাঁ। আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। কিন্তু এটাই আমার জীবনে অনন্য সুযোগ, যা ইতিহাসের ওপর প্রভাব রাখতে পারে। সৈনিক হিসেবে আমি আমার সর্বোত্তম সামথর্য ও বিবেক দিয়ে পরিচালিত হওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি রাজনীতিক নই, রাজনীতির সব সমস্যা বুঝতেও পারি না। আমাকে কাজ দেওয়া হয়েছিল। আমি সবচেয়ে ভালো উপায়ে তা করতে চেষ্টা করেছি। ব্যস, এটুকুই।
প্রথম আলো: শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা মূল্যায়ন করুন।
জ্যাকব: ইন্দিরা গান্ধী সাহস ও অঙ্গীকার প্রদর্শন করে গেছেন পুরো সময়। তিনি নিক্সন-কিসিঞ্জারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেপথ্যে ছিলেন তিনি এবং সেই যোগ্যতা তাঁর নিরঙ্কুশভাবেই ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাই ইন্দিরার জীবনের সর্বোত্তম মুহূর্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর ‘ফুল ক্রেডিট’ প্রাপ্য। সেটা ছিল তাঁর রাজনৈতিক ইচ্ছা। এ প্রসঙ্গে ইন্দো-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির কথাও বলতে হয়, যা ছিল পাকিস্তান ছাড়াও চীনের তরফে সম্ভাব্য কোনো অনিষ্টের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ।
প্রথম আলো: কেন ইন্দিরা এমন সাহসিকতার সঙ্গে বাংলাদেশ অভ্যুদয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। আপনার মূল্যায়ন কী?
জ্যাকব: ইন্দিরা ছিলেন গণতান্ত্রিক নেতা। তিনি দেখলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মুজিবকে স্তব্ধ করা হয়, তাঁকে কারাগারে নেওয়া হয়। নৃশংসতা, উদ্বাস্তু স্রোত তাঁকে বিচলিত করে।
প্রথম আলো: একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাদের নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থ ও পররাষ্ট্রনীতির আলোকে বাংলাদেশের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি ভারতের অবস্থানকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
জ্যাকব: যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়। কারণ, তাদের মাধ্যমে তারা চীনের সঙ্গে দোস্তি করার উদ্যোগ নেয়। অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ছিল আমাদের মৈত্রী চুক্তি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির বিপক্ষে ছিল। তাই তারা মৈত্রী চুক্তি করল। চীন যাতে সংঘাতে না জড়ায়। তারা জড়ালে আমাদের জন্য যুদ্ধজয় কঠিন হতো।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের বিজয়কে যদি আমরা কেবলই সামরিক নিরিখে দেখি, তাহলে বিশ্বের ইতিহাসে এর কি কোনো নজির আছে?
জ্যাকব: বাংলাদেশে কিন্তু মূলত ছিল জনগণের সংগ্রাম। আমরা কেবল তাতে সহায়তা দিয়েছি।
প্রথম আলো: অন্য কোনো নজির?
জ্যাকব: ভিয়েতনামেরটাও স্বাধীনতার লড়াই। মার্কিন হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে যার সূচনা। তবে সেটা ভিন্ন প্রকৃতির। বাংলাদেশে জনগণের সংগ্রাম। মুক্তিযোদ্ধারা দারুণ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। আমেরিকায়ও স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল। তারা ব্রিটিশদের উৎখাত করে। ব্রিটিশরা সাতচল্লিশে ভারত ছেড়ে যায়। আর ভারত ভাগ তো বিপর্যয় ডেকে আনে।
প্রথম আলো: অনেকে বলেন, ভারতে নিযুক্ত শেষ ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন বাংলাদেশের জন্ন দেখেছিলেন।
জ্যাকব: আমি জানি না। তাঁর সঙ্গে মাত্র দুবার আমার সাক্ষাৎ ঘটে। প্রথম দেখা, আমি তখন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। ১৯৪২ সালের আগস্টে জাহাজে চেপে বোম্বে থেকে বসরায় যাই। উত্তর ইরাকে কর্মরত ছিলাম কিছুদিন। এরপর সমুদ্রপথে করাচি হয়ে শিয়ালকোট। অতঃপর বার্মায়। আরাকান উপকূলীয় যুদ্ধে আমরা রামরি দ্বীপ দখল করি। এ সময় জাপানি বিমান হামলায় আমি আহত হই। আমাদের বলা হয়েছিল, আমরা মাদ্রাজে বিশ্রাম নেব। কিন্তু পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই আবার নতুন অভিযানের প্রস্তুতির নির্দেশ আসে। আমরা ভয়ানক হতাশ হই। এ সময় আমাদের নৈতিক মনোবল দেখতে এসেছিলেন লর্ড লুইস মাউন্টব্যাটেন। দ্বিতীয়বার দেখা, ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ট ব্রাগে। তখন অনেক বিষয় নিয়ে কথা হয়। তিনি ভারতের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা বলেন। কিন্তু দেশভাগের প্রশ্ন আসেনি।
প্রথম আলো: একাত্তরের আগে পাক সেনাবাহিনীতে আপনার অনেক বন্ধু-সহকর্মী ছিল?
জ্যাকব: হ্যাঁ, নিশ্চয়, নবম ডিভিশনের জিওসি শওকত রেজা। পরে তিনি ডিজিএমও হন। তিনি ছিলেন আমার ব্যাটারি ক্যাপ্টেন। বার্মা ক্যাম্পেইনে সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন।
প্রথম আলো: অন্য কেউ?
জ্যাকব: আজমত ছিলেন। সেকান্দার হায়াত।
প্রথম আলো: যুদ্ধের সময় কারও সঙ্গে কথা হয়েছিল?
জ্যাকব: আমি যাঁদের জানতাম তাঁদের কারও সঙ্গে কথা হয়নি। নবম ডিভিশন দুর্নাম অর্জন করেছিল। ম্যাসকারনহাস অনেক লিখেছেন।
প্রথম আলো: ১৬ ডিসেম্বরের পরে কি তাঁদের কারও সঙ্গে কথা হয়েছিল?
জ্যাকব: না। আমার তেমন কোনো আগ্রহও ছিল না। পরে কখনো পাকিস্তানেও যাইনি। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে শিয়ালকোটে ছিলাম। পাকিস্তানের স্মৃতি এতটুকুই।
প্রথম আলো: এমন কিছু বলুন, যা আপনি আপনার বইয়ে লেখেননি।
জ্যাকব: পাকিস্তানি একজন ব্রিগেডিয়ারকে নিয়ে পাকিস্তানি স্টাফ কারে চেপে আপনাদের পুরোনো এয়ারপোর্ট থেকে নিয়াজির হেডকোয়ার্টারে যাচ্ছিলাম। এ সময় আমাদের গাড়ি লক্ষ্য করে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছোড়েন।
প্রথম আলো: তার মানে ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার?’
জ্যাকব: অনেকটা তা-ই। (হাসি)
প্রথম আলো: এই ঘটনাটা কি বইয়ে নেই? কখনো কি প্রকাশ করেছেন?
জ্যাকব: না। আপনাকেই বলছি। আমি এ ঘটনা লিখিনি। কারণ, মুক্তিযোদ্ধারা তো আর আমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েননি। আমিই ছিলাম পাকিস্তান আর্মির গাড়িতে। তাঁরা তা জানতেন না। গুলি আসতেই আমি গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ি।
প্রথম আলো: আপনি এ ঘটনা আপনার বইয়ে একেবারেই উল্লেখ করেননি?
জ্যাকব: ঈষৎ ইঙ্গিত রয়েছে। ১৬ ডিসেম্বরের সকাল সোয়া নয়টায় জেনারেল স্যাম মানেকশ আমাকে টেলিফোন করেন। বলেন, দ্রুত ঢাকায় গিয়ে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের গোছগাছ করতে। যশোরে হেলিকপ্টার বদলে ঢাকার আকাশে পৌঁছাতে দেখি একটি হেলিকপ্টার চক্কর কাটছে। টারমাকে ১৮টি পাক যুদ্ধবিমান (পরে জেনেছি ওগুলো ছিল ভূপাতিত)। আমরা দেখলাম বিমানবিধ্বংসী কামানের নল আমাদের হেলিকপ্টারের দিকেই তাক করা। আমাদের এয়ার কমোডর ফিরে যেতেই চাইলেন। কিন্তু আমি পাইলটকে অবতরণের নির্দেশ দিই। পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকীর সাক্ষাৎ মিলল। জাতিসংঘ প্রতিনিধি ও ফরেন প্রেস কোরও ছিল। তো আমরা নিয়াজির সদর দপ্তরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। পথিমধ্যে মুক্তিবাহিনী আমাদের আটকায়। তারা মেজাজে যুধ্যমান, ভাঙচুর শুরুর জন্যও প্রস্তুত ছিল। আমি তাদের বোঝালাম, বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি রক্তপাতহীন ক্ষমতা হস্তান্তরই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
প্রথম আলো: আপনি বইয়ে লিখেছিলেন, ওই সময় ফরেন প্রেস ছিল। তারা কি গুলিবর্ষণের কথা জেনে গিয়েছিল।
জ্যাকব: না, তারা পরে এসেছিল।
প্রথম আলো: ১৬ ডিসেম্বর কয়টার দিকে এ ঘটনা ঘটে?
জ্যাকব: দুপুর ১২টার দিকে।
প্রথম আলো: আপনি বইয়ে লিখেছেন, ‘অন দ্য ওয়ে টু নিয়াজি’স হেডকোয়ার্টার্স, উই ওয়্যার স্টপড বাই দ্য মুক্তিবাহিনী’।
জ্যাকব: এখানে পড়তে হবে উই ওয়্যার স্টপড বাই ফায়ার (হাসি)। আমি গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে বলি, থামুন থামুন।
প্রথম আলো: আপনি কেন পাকিস্তানি আর্মির গাড়িতেই চড়েছিলেন?
জ্যাকব: আমরা তো কেবল হেলিকপ্টারে এসেছি। তাদের গাড়িতে না চড়ে উপায় কী? নিয়াজির হেডকেয়ার্টারে তো আমি হেঁটে যেতে পারব না।
প্রথম আলো: আপনি লিখেছেন, একাত্তরের যুদ্ধের কোনো কর্তৃপক্ষীয় বা নৈবর্যক্তিক বিবরণ এখনো বের হয়নি। একটি সরকারি ইতিহাস প্রস্তুত করা হলেও তা প্রকাশিত হয়নি। তবে এর লেখকদেরও সংবেদনশীল দলিলাদি দেখতে দেওয়া হয়নি।
জ্যাকব: বাষট্টি সালের যুদ্ধের ইতিহাস, হ্যাণ্ডারসন রিপোর্ট আজও অপ্রকাশিত। একাত্তরের ইতিহাস নিয়ে নানা দৃষ্টিভঙ্গি আছে।
প্রথম আলো: আপনি কি মনে করেন এটা প্রকাশিত হওয়া উচিত?
জ্যাকব: উচিত। কোনোভাবেই বিকৃত ইতিহাস কাম্য নয়। ট্রুথ মাস্ট কাম।
প্রথম আলো: ভারত সরকার ভাবতে পারে এ বিষয়ে এখনো স্পর্শকাতরতা রয়েছে। আপনি কি মনে করেন এটা এখন ছাপার সময়।
জ্যাকব: আমি তা-ই মনে করি। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেছে।
প্রথম আলো: যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে অনেক কিছুই ডিক্লাসিফাই বা উন্নুক্ত করেছে।
জ্যাকব: হ্যাঁ। সবচেয়ে চমকপ্রদ লেগেছে যে আত্মসমর্পণের পরেও কিসিঞ্জার নিক্সনকে বলছেন, ওয়েলডান, উই গট পাকিস্তান টু সিজফায়ার। এটা কোনো কথা হলো? আমেরিকানরা কিন্তু সারেন্ডার আশা করেনি।
প্রথম আলো: রাশানদের আশা কী ছিল?
জ্যাকব: আমি তা জানি না। তবে তারা আমাদের চাপ দিচ্ছিল যাতে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করি।
প্রথম আলো: আজ এত বছর পরে আপনার কী মনে হয়? নিক্সন-কিসিঞ্জার কেন এভাবে মরিয়া হয়ে পাকিস্তান ও ইয়াহিয়ার পক্ষ নিল।
জ্যাকব: কৃতজ্ঞতা থেকে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দোস্তির সেতুটা তৈরি করেছিল পাকিস্তান।
প্রথম আলো: এটাই কি একমাত্র কারণ ছিল?
জ্যাকব: আমার তাই মনে হয়। অন্য কারণ থাকতে পারে। তবে এটাই মূল কারণ।
প্রথম আলো: একাত্তরের যুদ্ধের বিষয়ে আপনার কাছে কি কোনো মূল্যবান দলিল রয়েছে? ব্যক্তিগত কোনো সংগ্রহশালা?
জ্যাকব: কোনো দলিলপত্র নেই। বইটা লিখেছি আমার ব্যক্তিগত নোট থেকে।
প্রথম আলো: আপনি কি ডায়েরি লিখতেন?
জ্যাকব: না, তবে নোট রেখেছি।
প্রথম আলো: সেই নোট কি আছে? দেখতে পারি?
জ্যাকব: বই লেখার পর আমি তা নষ্ট করে ফেলেছি। আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহ কিছুই নেই। হাতের লেখা খুব খারাপ। তাই নোটগুলোও রাখিনি। তাতে আমার মত ইত্যাদি লেখা ছিল।
প্রথম আলো: তাই বলে কোনো স্মৃতিই নেই?
জ্যাকব: কিছুই নেই। কেবল একটি চিঠি। জেনারেল গিলের। কিন্তু তা যুদ্ধের পরে লেখা। অবশ্য জেনারেল মানেকশ ৮ মার্চ ১৯৭৮ আমাকে যে একটা প্রশ্নপত্র দিয়েছিলেন সেটাও ছিল। তার মূল কপি এখন নেই। নোটের সঙ্গে কিছু কাগজপত্রও আমি নষ্ট করেছি।
প্রথম আলো: তাহলে যুদ্ধের কোনো প্রত্যক্ষ স্মৃতিই নেই?
জ্যাকব: তিন সপ্তাহ আগে আমি একটি ভিডিও ক্লিপ পেয়েছি। ৮ ডিসেম্বরের দিকে পাকিস্তানিরা পশ্চিমাংশে মহড়া দিচ্ছিল। তারা গুজব প্রচার করছে অমৃতসর, শ্রীনগর, জম্মু দখল করে নিয়েছে। তারা যুদ্ধে জয়ী হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে তোমরা লড়াই চালিয়ে যাও। এসব খন্ডন করে তখন যে ব্রিফ করছিলাম তারই একটি ভিডিও ক্লিপি।
আমাদের সিস্টেমে কোনো রেকর্ড ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার নিয়ম নেই। তাই রাখিনি। তবে আমার নোটে রাখা এমন কোনো একটি বাক্যও রাখিনি, যা বইতে লিখিনি। যুদ্ধের পরে আমি কয়েকটি ব্যক্তিগত চিঠি পেয়েছিলাম, তা দেখাব না। সে চিঠিগুলো যুদ্ধবিষয়ক নয়, বন্ধুবান্ধবদের লেখা। কোনো সরকারি কিছুই আমার কাছে নেই, এটা নিশ্চিত। আমি বইতে যা দিইনি, তার চেয়ে ঢের বেশি আপনাকে বলে ফেলেছি।
প্রথম আলো: আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে আপনার হাতে একটি ঘড়ি দেখা গেছে। সেটি থাকলে ছবি নিতে চাই।
জ্যাকব: হ্যাঁ সেটি কিন্তু রক্ষিত আছে। তবে আপাতত দেখাতে পারছি না। কারণ তালাবদ্ধ।
প্রথম আলো: আপনি কেন নিয়াজিকে তার তরবারি সমর্পন করতে বলেছিলেন?
জ্যাকব: ইতিহাস প্রাচীন প্রথা হলো পরাজিত জেনারেল তাঁর তরবারি বিজয়ী জেনারেলের কাছে সমর্পন করেন। নিয়াজি বললেন, আমার তরবারি নেই। বললাম, তাহলে পিস্তল দিন, তাতেই চলবে। আমি যখন তার পিস্তলটি পরীক্ষা করলাম, দেখলাম অকেজো, কতকাল পরিস্কারই করা হয়নি। এটা নিশ্চয় কোনো জেনারেলের পিস্তল হতে পারে না। যাক, সমর্পনতো প্রতিকী ছিল।
প্রথম আলো: পিস্তলটি এখন কোথায়?
জ্যাকব: দেরাদুনের মিলিটারি একাডেমিতে।
প্রথম আলো: মুক্তিযুদ্ধের সবর্াধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?
জ্যাকব: ওসমানী মহান জাতীয় নেতা ছিলেন। কোনো সমস্যা ছিল না তাঁর সঙ্গে আমার। আমি তাঁকে খুবই পছন্দ করি। কিন্তু আমরা ভাবতাম ভিন্নভাবে। কেবল ওসমানীই নন। মানেকশসহ অনেকের সঙ্গেই আমার ভাবনার বৈপরীত্য ছিল। ওসমানী আমাকে বলেছিলেন, ইস্ট বেঙ্গলকে তিনি নিয়মিত পদাতিক ব্যাটালিয়ন হিসেবে দেখতে চান। আর সেটি পাকিস্তান আর্মির মডেলেই রাখতে আগ্রহী।
প্রথম আলো: এতে কি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল?
জ্যাকব: পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সৃষ্টি করা হয়েছিল পাঞ্জাবের মতো ভূখন্ডে নির্দিষ্ট ধরনের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য। পাকিস্তান আর্মির ডিজাইনটা ছিল প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যই। এমনকি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকেও গড়া হয়েছিল ভারতের বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ কোনো সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য। তাদের যেসব অস্ত্রে প্রশিক্ষিত করা হয় তার পেছনেও ছিল ওই চিন্তা। সুতরাং একাত্তরের যে সময়টাতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের যুদ্ধ করতে হয় সে জন্য তাদের একটি ভিন্ন রণকৌশল নেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যাতে তারা নদীমাতৃক, ঝোপঝাড়, ধানক্ষেতবেষ্টিত বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত পারে।
প্রথম আলো: কেন ওসমানী সেটা করেছিলেন?
জ্যাকব: অন্য কোন কারণে নয়। তিনি যেহেতু পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষিত ছিলেন, তাই তিনি সেই সাংগঠনিক কাঠামোর আলোকেই হয়তো ভেবেছেন। অন্য কোনো কারণ নয়। ওসমানি এতেই অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সেভাবেই দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। তবে পাকিস্তান আর্মিকে ধানক্ষেত, বনবাদাড় ও নদীবেষ্টিত ভুখণ্ডে যুদ্ধের জন্য তৈরি করা হয়নি। তাঁরা চেনে পাঞ্জাবের ভূখন্ড। সেক্ষেত্রে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির আলোকে তৈরি করা প্রয়োজন ছিল।
প্রথম আলো: তাহলে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ওসমানী সাহেবের ওই চিন্তা ভুল ছিল?
জ্যাকব: না, আমি তাঁর সামরিক পরিকল্পনার বিচার করতে পারি না। তিনি বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে পরিকল্পনা নিয়েছেন। আমি আমার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের ভিন্ন মত ছিল, কেবল এটুকু বলতে পারি।
প্রথম আলো: আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে তাঁর অনুপস্থিতিকে কীভাবে দেখেন?
জ্যাকব: আমি নির্দেশনা দিয়েছিলাম যে, এমএজি ওসমানি এবং মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি একে খোন্দকার থাকবেন। তাছাড়া তিনি তো যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে জনতেন। কিন্তু তিনি সিলেট গিয়েছিলেন। তাকে আনতে হেলিকপ্টার পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু পথে বৈরী গুলিবর্ষণে সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যথাসময়ে সেটি আর মেরামত করা যায়নি।
প্রথম আলো: তিনি কি তবে সুচিন্তিতভাবেই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান এড়িয়েছিলেন?
জ্যাকব: আমি তা জানি না। আমি তাঁর উপস্থিতি একান্তভাবেই চেয়েছিলাম। সুতরাং সেটা আমাদের ভুল নয়। তাকে ইচ্ছে করে দূরে সরিয়ে রাখার কথা নেহাৎ অপপ্রচার। খন্দকার তো ছিলেন।
প্রথম আলো: জেনারেল ওসমানী ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও সামরিক উপদেষ্টা হয়েছিলেন। তাঁকে বাছাই করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনার কি কোনো ধারণা ছিল?
জ্যাকব: আমি জানতাম না। তিনি জ্যেষ্ঠ ছিলেন। আগেই বলেছি, আমার সঙ্গে অনেক বিষয়ে তাঁর মতের গরমিল হয়, সমস্যা হয়।
প্রথম আলো: আপনি যুদ্ধজয়ের জন্য মুক্তিবাহিনীকে এবং ওসমানী নিয়মিত বাহিনীকে প্রধান শক্তি বিবেচনা করেছিলেন?
জ্যাকব: ঠিক তাই। আমি আমার সবটুকু মনোযোগ মুক্তিবাহিনীর প্রতি ঢেলে দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি নিয়মিত ব্যাটালিয়ন গড়তেই মনোযোগী হন। আমি তাতে কিছু মনে করিনি। কিন্তু সমস্যা হয়, আমি মুক্তিবাহিনীর জন্য যাদের সবচেয়ে মেধাবী ও যোগ্য মনে করেছি, তিনি তাঁর বাহিনীর জন্য তাদেরকেই আশা করলেন। নিয়মিত বাহিনী গড়তে সময়ের প্রয়োজন ছিল বেশি। আমি মুক্তিবাহিনীর প্রতি খুবই আস্থাবান ছিলাম। বাংলাদেশ কিন্তু মুক্তিবাহিনী ও নিয়মিত উভয় বাহিনীর জন্য গর্ব করতে পারে। কারণ তাঁরা অসামান্য ভুমিকা রাখে। তবে তুলনামূলকভাবে মুক্তিবাহিনীই নিয়মিত বাহিনীর চেয়ে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। তাদের ভূমিকাটাই বড় ছিল।
প্রথম আলো: তাঁর সঙ্গে আর কি মতানৈক্য ঘটেছিল যদি একটু খুলে বলেন-
জ্যাকব: আমি ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল অঞ্চলে সেনা সমাবেশ ঘটানোর পরিকল্পনায় সংকল্পবদ্ধ থাকি; কিন্তু ওসমানী তা চাননি। তিনি যুক্তি দিলেন, তাঁর জন্নস্থান সিলেট। পরিচিত এলাকা। তাই তিনি তাঁর বাহিনীকে সিলেট অঞ্চলেই মোতায়েন করতে চাইলেন। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে দীর্ঘ বৈঠক হলো। আমরা একমত হতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত ‘হি মুভড হিজ ফোর্সেস টু সিলেট।’
প্রথম আলো: আপনি লিখেছেন, ওসমানীর সেকেন্ড ইন কমান্ড এ কে খন্দকার উত্তম অফিসার ছিলেন।
জ্যাকব: জেনারেল ওসমানী যেভাবে ’রিজিড’ ও ‘ভেরি সেট’ আইডিয়ার লোক ছিলেন, খন্দকার ছিলেন এর উল্টো। তিনি যথেষ্ট সদাশয় ছিলেন। দেখুন এনিয়ে যেন আবার অহেতুক বিতর্ক না হয়। আবার বলছি, ওসমানী ছিলেন মহান সৈনিক। আমি যাকে তাঁর কঠোরতা বলছি, সেটাই হয়তো তাঁর বিবেচনায় সঠিক পথ ছিল। তাঁর নিজস্ব ধ্যান-ধারণা তো থাকাটাই স্বাভাবিক। আমি তাঁর ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
প্রথম আলো: যুদ্ধকালে আপনি বিদেশি সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন?
জ্যাকব: না, সাক্ষাৎকার দিইনি। তবে তাদের অফ দ্য রেকর্ড ব্রিফ করেছিলাম। লন্ডনের সানডে টাইমস-এর নিকোলাস টমলিনের প্রথম ও শেষ রিপোর্ট আমার সঙ্গে কথার ভিত্তিতেই হয়েছিল। টমলিন পরে গোলান উপত্যকা কভার করতে গিয়ে নিহত হন।
প্রথম আলো: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার কথা হয়েছিল?
জ্যাকব: এক দিনই। দিনটা হয়তো ২৩ মার্চ হবে। ভারতের সেনা প্রত্যাহারের ঠিক আগে। চার-পাঁচ ঘণ্টা তাঁর কাছে ছিলাম। তাঁকে খুবই বিশ্বস্ত ও ডেডিকেটেড মনে হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে মেঝেতে বসেছিলাম। জায়গাটা তাঁর সরকারি দপ্তর হবে। কিন্তু সেখানে কোনো চেয়ার ছিল না। ফোনের পর ফোন আসছিল। তিনি বিভিন্ন ধরনের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। কিন্তু তার কোনো রেকর্ড রাখা হচ্ছিল না। তাঁকে পছন্দ হয়েছে। তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। তাজউদ্দীনও আমার খুব পছন্দের ছিলেন।
প্রথম আলো: আপনি কি তাঁর সঙ্গে মেঝেতেই বসেছিলেন? বাড়িটা তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন?
জ্যাকব: হ্যাঁ। তবে জায়গাটা আমি স্মরণ করতে পারি না। তিনি সেদিন দেশের উন্নয়ন, তাঁর জনগণের কিসে কল্যাণ হবে সে বিষয় নিয়েই কথা বলেছিলেন।
প্রথম আলো: সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে কথোপকথন মনে আছে?
জ্যাকব: খালেদ মোশাররফের সঙ্গে সাধারণ আলোচনা হয়েছে। আপনি আমাকে ৩৭ বছর আগের কথা স্মরণ করতে বলছেন।
প্রথম আলো: জিয়াউর রহমানের সঙ্গে?
জ্যাকব: বিশেষ কিছু মনে পড়ছে না। তবে কয়েকবারই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছে। তিনি খুবই উন্নত সৈনিক ছিলেন।
প্রথম আলো: কোথায় দেখা হয়েছিল?
জ্যাকব: আমি যখন পূর্বাঞ্চলে সফর করছিলাম। হয়তো পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে।
প্রথম আলো: কোন মাসে?
জ্যাকব: আমি অনেক ঘুরেছি। কোন মাস মনে পড়ছে না। মে থেকে জুলাইয়ের কোনো সময়। জলিলকে জানতাম। জলিল কোথায় এখন?
প্রথম আলো: তিনি মারা গেছেন। আপনি লিখেছেন, জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।
জ্যাকব: জিয়া ২৭ মার্চে ঘোষণা দেন।
প্রথম আলো: আপনি বইয়ে তারিখ এটাই লিখেছেন। আপনি নিজেও শুনেছিলেন কি?
জ্যাকব: আমি নিজে শুনেছি। আমরা অনেকেই শুনেছি। তবে খুব স্পষ্টভাবে শুনতে পাইনি।
প্রথম আলো: আপনি লিখেছেন, আপনি মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ ধারণাটা আপনার মাথায় কীভাবে এল?
জ্যাকব: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জেনারেল দ্য গল স্বাধীন ফ্রেঞ্চ সরকার গঠন করেছিলেন। আমি সেই ভাবনা থেকে একটি ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করে তাজউদ্দীনকে দিই। তাঁরা অনেক আইনবিদকে নিয়ে বৈঠক করেছিলেন।
প্রথম আলো: আপনি কি ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করে দিয়েছিলেন?
জ্যাকব: না। ঘোষণাপত্রের আকারে একটি শর্ট ড্রাফট দিয়েছিলাম।
প্রথম আলো: আপনার কি দু-একটি বাক্য মনে পড়ে?
জ্যাকব: না (হাসি)। অনেক আগের কথা।
প্রথম আলো: তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আপনার আলোচনা−
জ্যাকব: তিনি পাকিস্তানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে খুবই সোচ্চারকণ্ঠ ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চেয়েছিলেন। এটুকু আমি স্মরণ করতে পারি।
প্রথম আলো: মুক্তিযুদ্ধকালে আপনি কি শেখ মুজিবুর রহমানের নামে কোনো বার্তা পেয়েছিলেন?
জ্যাকব: না।
প্রথম আলো: প্রবাসী সরকার কতটা যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করেছিল?
জ্যাকব: তারা খুবই যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। তাজউদ্দীন মেধাবী ছিলেন। তিনি খুবই মানবিক, জ্ঞানসমৃদ্ধ ও মন ছিল বিশাল। চিন্তা-ভাবনাতেও ছিলেন উদারনৈতিক। ওই সরকারের সবাই ডেডিকেটেড ছিলেন। কলকাতায় পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনার ও অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের প্রস্তাব আমিই কিন্তু তাজউদ্দীনকে পৌঁছে দিই। বললাম, তাঁরা পেনশন ও চাকরিজীবনের নিশ্চয়তা চান। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন তা নিশ্চিত করেন। এরপর তাঁরা এলেন।
প্রথম আলো: খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে আপনার কখনো যোগাযোগ বা আলাপের সুযোগ ঘটেছিল?
জ্যাকব: না।
প্রথম আলো: তাত্ত্বিকভাবে ভারতীয় সেনাদের সহায়তা ছাড়া মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব ছিল?
জ্যাকব: খুবই হাইপোথেটিক্যাল প্রশ্ন। আমি যেটা বলতে পারি, তা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল একটি যৌথ প্রচেষ্টা। ভারতীয় সেনা ও মুক্তিবাহিনী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। উভয়ে উভয়ের প্রতি নির্ভরশীল ছিল। উভয়ের মিলিত প্রচেষ্টায় ঢাকার আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এ জন্য উভয়ে কৃতিত্বের দাবিদার।
প্রথম আলো: আপনি জেনারেল মানেকশর পরিকল্পনা পরিহার করে ঢাকার পতন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেন এবং তাতে সফলও হন। এ কথা যখন আপনি বইয়ে প্রকাশ করেন, তখন মানেকশর কী প্রতিক্রিয়া ছিল? এ নিয়ে কি কোনো কথা হয়েছে আপনাদের মধ্যে?
জ্যাকব: আমার বইটি ১৯৯৭ সালে প্রথম বের হয়। তখন মানেকশ বেঁচেছিলেন। তিনি কোনো বক্তব্য দেননি। কারণ, আমি যা বলেছি তা তো রেকর্ডের ভিত্তিতে। সবকিছুই সেনা সদর দপ্তরে রক্ষিত আছে।
প্রথম আলো: কেন ও কীভাবে আপনি এমন অভাবনীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন?
জ্যাকব: অপারেশনের মূল আদেশে টার্গেট ছিল খুলনা ও চট্টগ্রাম এবং তার ভূখণ্ড। পরোক্ষ ইঙ্গিত ছিল সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা। আমি বুঝলাম, কোনো আধাখেঁচড়া বিজয় দিয়ে প্রবাসী সরকার করা যাবে না। দরকার পূর্ণ বিজয়। আর সে ধরনের বিজয় ঢাকাকে মুক্ত না করে পারা যাবে না। ঢাকা কেবল বাংলাদেশের জিওপলিটিক্যাল নয়, জিওস্ট্র্যাটেজিক্যাল ও জিওকালচারাল কেন্দ্রবিন্দুও বটে। সুতরাং ঢাকাকে বাদ দিয়ে কোনো যুদ্ধজয় সফল হতে পারে না। এই ভাবনা থেকেই আমি সেনা সদর দপ্তরের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করি। তা ছাড়া পুরো যুদ্ধে আমার সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ছিল জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ। নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন। কারণ, যুদ্ধবিরতি ঘটিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অজর্নের প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করাই ছিল শত্রুশিবিরের কৌশল। নিরাপত্তা পরিষদে কখন কী ঘটে সে চিন্তায় আমি বহু নিঘর্ুম রাত কাটিয়েছি। বিশেষ করে ভেটো পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তা আমাকে অস্থির রাখত। আমাদের আসন্ন যুদ্ধজয় সম্পকের্ তখন পযর্ন্ত আমরা বিশ্বকে তেমন কিছুই দেখাতে পারছিলাম না। বড় কোনো শহরই আমরা দখল করতে পারিনি।
প্রথম আলো: ঢাকাকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্য কোনো সমর ইতিহাস থেকে কোনো পাঠ নিয়েছিলেন কি?
জ্যাকব: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল। মধ্যপ্রাচ্য থেকে বার্মা, বার্মা থেকে সুমাত্রা। সুমাত্রার আরাকানসহ আরও কয়েকটি স্থানে আমরা অবতরণ করেছিলাম। কিন্তু সবাই ছিল সাবসিডিয়ার। মূল লক্ষ্য ছিল রেঙ্গুন। বার্মাকে স্বাধীন করা। রেঙ্গুনকে দখল করা ছাড়া বার্মাকে মুক্ত করার রণকৌশল সফল হওয়া সম্ভব ছিল না। জাপানি বাহিনী রেঙ্গুন থেকেই পুরো বার্মা নিয়ন্ত্রণ করছিল। তো আমি ওই পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করলাম। ওই অবস্থা শতভাগ অভিন্ন নয়, তবে মূল বিবেচ্য বিষয় ছিল অভিন্ন। আমি বুঝলাম খুলনার মতো কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পুরো দখল করে নিতে পারলেও তা খুব কাজে দিত না।
প্রথম আলো: তবে জেনারেল মানেকশ তথা ভারতের সেনা সদর দপ্তরের পরিকল্পনায়ও নিশ্চয় একটা কৌশলগত যুক্তি ছিল।
জ্যাকব: ঠিক আছে, আমাকে বলতে দিন। আমি পাকিস্তানি বাহিনীর রণকৌশল খতিয়ে দেখলাম। তারা ভূখণ্ড রক্ষায় ব্যতিব্যস্ত ছিল, এক ইঞ্চি ছাড়বে না, যা ছিল মূর্খতা। শহরগুলোকে রক্ষায় তারা ছিল ভীষণ ব্যাকুল। নিয়াজি যদি নদী পারাপারের স্থানগুলোতে পাহারা বসাতেন, তাহলে আমাদের খুব দুর্ভোগ পোহাতে হতো।
প্রথম আলো: সিএনবিসি প্রচারিত সাক্ষাৎকারে আপনি ফিল্ড মার্শাল মানেকশর মূল্যায়নে ভারত সরকারের রক্ষণশীলতা নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। আপনার প্রতি সরকার কতটা সদয় হয়েছিল?
জ্যাকব: আমি একজন সৈনিক। সৈনিক হিসেবে আমি বিধিবিধানের বাইরে একচুলও নড়তে চাই না। সেনা কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে আচরণবিধি মানতে হবে। তাই আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। ভারতীয় সেনাবাহিনী অরাজনৈতিক।
প্রথম আলো: আপনি কি বিশেষ কোনো ভাতা বা আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন?
জ্যাকব: ৩৭ বছর সেনাবাহিনীতে কাটানোর পর মাসে এক হাজার ১০০ রুপি করে পেনশন ভাতা পেতে শুরু করি। মানেকশ সেনাপ্রধান ছিলেন। তাই পেতেন এক হাজার ৩০০ রুপি। এটা নিশ্চয় ‘জেনারাস’ নয় (হাসি)। সৈনিক ও সেনা কর্মকর্তারা ক্ষুদ্র বেতনে চাকরি করেন। পেনশনও পান সেভাবে। তবে নতুন পে কমিশন পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়েছে।
প্রথম আলো: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবমুক্ত হওয়া পেন্টাগন দলিল থেকে দেখা যাচ্ছে, একাত্তরের যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে রুশ-মার্কিন আলোচনা চলছিল কী করে পূর্ব পাকিস্তানকে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করা যায়।
জ্যাকব: যুদ্ধের রাজনৈতিক দিক সম্পর্কে আমি বলতে পারব না; যদিও মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিংয়ের সঙ্গে আমার একাধিক বৈঠক হয়েছিল।
প্রথম আলো: যুদ্ধকালে কতবার কিটিং আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন?
জ্যাকব: দুবার। তিনি কলকাতাতেই আসেন।
প্রথম আলো: কী ছিল আপনাদের আলোচনার বিষয় এবং এর ফলাফল?
জ্যাকব: কিটিংকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, নিক্সন-কিসিঞ্জার কেন অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন দিচ্ছেন, যারা বাংলাদেশের জনগণের ওপর নৃশংসতা চালাচ্ছে? ফোর্ট উইলিয়ামে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকের দিন আর্মি কমান্ডার অনুপস্থিত ছিলেন। আমিই তাঁর সঙ্গে কথা বলি। আমার মনে আছে, আমার প্রশ্নের জবাবে কিটিংয়ের সংবেদনশীল মুখ ঈষৎ উজ্ব্বল হলো। তবে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ কিংবা তাঁর সরকারের সমর্থনে কোনো বক্তব্য দেননি।
প্রথম আলো: কিটিং কোনো বিষয়ে অনুরোধ করেছিলেন?
জ্যাকব: না। কোনো বার্তাও বয়ে আনেননি।
প্রথম আলো: একাত্তরে সিনিয়র বুশ জাতিসংঘে ভারতকে আগ্রাসী শক্তি বলেছিল। এখন আপনি জীবদ্দশায় দেখলেন জুনিয়র বুশ পরমাণু চুক্তি করে ভারতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেমন লাগছে আপনার?
জ্যাকব: আমি আপনার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে কথা বলছি। পরমাণু বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আমি এক সাধারণ সৈনিক। আমি যা জানি না, সে বিষয়ে কথা বলতে চাই না।
প্রথম আলো: পশ্চিম পাকিস্তান জয়ের কি কোনো লক্ষ্য ছিল? অবমুক্ত করা কোনো দলিল থেকে এমন আলামত মিলছে।
জ্যাকব: না। কোনো পরিকল্পনা ছিল না। পশ্চিম ফ্রন্টে সেনা মোতায়েন দরকার ছিল। আমি এখান থেকে পাঠাতে প্রস্তুত ছিলাম।
প্রথম আলো: বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির প্রয়োজনে−
জ্যাকব: পশ্চিম পাকিস্তানকে ধ্বংসের কোনো উদ্দেশ্যই আমাদের ছিল না। ‘ইট ওয়াজ এ লোকাল ওয়ার।’
প্রথম আলো: পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর ভারতের করায়ত্ত করে নেওয়া প্রসঙ্গও তাতে দেখছি−
জ্যাকব: না। কোনো আলোচনাই হয়নি। আর্মি কখনো এমন আলোচনায় যোগ দেয়নি।
প্রথম আলো: এমন ইঙ্গিতের সপক্ষেও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ডিক্লাসিফাইড (উন্নুক্ত) দলিল রয়েছে−
জ্যাকব: আমি জানি, এ রকম কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। আমি বরং আপনাকে তাজউদ্দীনের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনার কথা বলতে পারি। দ্য গল কী করে ইংল্যান্ডে গিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন, তা আমি তাঁকে বললাম। তিনিই আমাকে একটি খসড়া দিতে বললেন। আমি তো আইনের লোক ছিলাম না। কয়েকটি পয়েন্ট মুসাবিদা করে দিলাম।
প্রথম আলো: রাজাকার, আলবদরদের সম্পর্কে কিছু বলবেন?
জ্যাকব: তারা তো আপনাদেরই লোক। আপনারাই ভালো জানবেন তাদের সম্পর্কে। আপনারাই তাদের সম্পর্কে ভালো বিচার করার অবস্থানে রয়েছেন।
প্রথম আলো: না। আপনাকে বিতর্কে টানছি না। জানতে চাচ্ছিলাম রাজাকাররা কীভাবে রণাঙ্গনে আপনাদের জন্য প্রতিকূলতা তৈরি করেছিল।
জ্যাকব: হ্যাঁ। তারা যশোরসহ বহুস্থানে আমাদের অগ্রযাত্রায় বাধার সৃষ্টি করে। তারা অনেককে হত্যা করেছে। আমরা যশোর এলাকা থেকে মাগুরা অভিমুখে একদল সেনা পাঠিয়েছিলাম। ৭ বা ৮ ডিসেম্বর। রাজাকাররা পথিমধ্যে বাধা দেয়। সেই সংঘর্ষে আমরা একজন সিও ও বেশ কিছুসংখ্যক সেনা হারাই। একজন লে. কর্নেলসহ ১৩-১৪ জন প্রাণ হারায়।
প্রথম আলো: তারা নিহত হয় কি কেবল রাজাকারদের হাতেই, নাকি পাকসেনারা সহায়তা দিয়েছিল?
জ্যাকব: না। এ ঘটনায় কেবল রাজাকাররাই ছিল।
প্রথম আলো: দেশের অন্যত্র?
জ্যাকব: চট্টগ্রামসহ আরও অনেক স্থানে ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে রাজাকারদের যুদ্ধ হয়েছে। একইভাবে তারা আপনাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেও লড়েছে।
প্রথম আলো: কতজন ভারতীয় সেনা প্রাণ হারায়?
জ্যাকব: এক হাজার ৪২১ নিহত এবং চার হাজার ৫৮ জন আহত হয়। তিনজন জেসিও এবং ৫৩ জন ওআর আজও নিখোঁজ রয়েছেন।
প্রথম আলো: ঢাকার পতন নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আপনার সম্পর্কে মানেকশর মন্তব্য কী ছিল?
জ্যাকব: এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার কখনো আলোচনা হয়নি। তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।
প্রথম আলো: তিনি কি আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন?
জ্যাকব: আমি জানি না, তিনি আমাদের প্রশংসা করেছিলেন কি করেননি।
প্রথম আলো: তিনি কি আপনার বই সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেছিলেন?
জ্যাকব: না। কখনোই নয়।
প্রথম আলো: আপনার যুদ্ধ-পরিকল্পনা নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক ও অন্যান্য মহলের মূল্যায়ন কেমন?
জ্যাকব: তা আমার জানা নেই। আমার কাজ আমি করেছি। একাত্তরে রণাঙ্গনে আমি আমার সর্বোত্তম সামথর্য অনুযায়ী তা করেছি। যত দূর সম্ভব বিবেক দ্বারা পরিচালিত হতে চেয়েছি। আমি আমার কাজের বিচার করতে পারি না, এটা অন্যের কাজ।
প্রথম আলো: ১৬ ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের শেষ মুহূর্তগুলো একটু স্মরণ করুন।
জ্যাকব: যখন আমি নিয়াজির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছিলাম তিনি বললেন, কে বলেছে যে আমি আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছি। আমি এসেছি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে। তাঁর অধীনে ২৬ হাজার ৪০০ সেনা তখন ঢাকায়। ঢাকার দক্ষিণে আমাদের সেনাসংখ্যা মাত্র তিন হাজার। হামিদুর রহমান কমিশন নিয়াজিকে এ প্রশ্ন করেছিল যে ২৬ হাজার সেনা যখন ঢাকায়, তখন তারা আরও কয়েক সপ্তাহ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারত। তখন জাতিসংঘের অধিবেশনও চলছে। ভারতীয় সেনাদের ফিরে যেতে বাধ্য করার একটা সম্ভাবনা ছিল। তাহলে তারা কেন জনসম্মুখে মানমর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে লজ্বাজনকভাবে আত্মসমর্পণ করল? এমনকি তাদের গার্ড অব অনার পর্যন্ত দিতে হলো? নিয়াজি উত্তর দিয়েছেন, ‘জেনারেল জ্যাকব আমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছিলেন।’ তিনি তাঁর বইয়েও তা লিখেছেন। আরও বলেছেন, তাদেরকে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছি। এসবই অসত্য, রাবিশ। আমি নিয়াজিকে ব্ল্যাকমেইল করিনি। এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
প্রথম আলো: আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া কীভাবে তৈরি হলো?
জ্যাকব: আমার নিজের হাতেই টাইপ করা। আমি ১৩ ডিসেম্বরে যখন নিয়াজির সঙ্গে কথা বলা শুরু করি, তখনো আমার সরকারের তরফে কোনো কনফারমেশন ছিল না। আমি নিজেই উদ্যোগী ছিলাম।
প্রথম আলো: আইনগত দিক কীভাবে খতিয়ে দেখেছিলেন?
জ্যাকব: আমি বিশেষজ্ঞ ছিলাম না। কিন্তু ইতিহাসের আশ্রয় নিয়েছি। যেটা চূড়ান্ত হয়ে এল, সেটা আসলে আমারই, কেবল হেডিংটায় ভুল ছিল। খসড়াটি আমি দিল্লি পাঠাই।
প্রথম আলো: রেসকোর্স কেন বেছে নিলেন?
জ্যাকব: আমি তাঁকে বললাম, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে রেসকোর্স ময়দানে, জনতার সামনে। নিয়াজি বললেন, না। আমার অফিসে হবে। আমি বললাম, না, ওখানেই হবে। ঢাকার মানুষ উপস্থিত থাকবে। কারণ, তারাই বড় বেশি নির্যাতন ও নৃশংসতার শিকার হয়েছে। রেসকোর্সের সেই আত্মসমর্পণই ইতিহাসের একমাত্র পাবলিক সারেন্ডার।
প্রথম আলো: আত্মসমর্পণের দলিল চূড়ান্তভাবে কলকাতায় সই হয়েছিল?
জ্যাকব: আত্মসমর্পণের যে দলিলটি কলকাতা থেকে টাইপ করে অরোরা বয়ে আনেন, তাতে কিছু ভুলত্রুটি ছিল। দুই সপ্তাহ পরে কলকাতায় সেটি দ্বিতীয়বারের মতো সই হয়েছিল। চুক্তির হেডিংয়ে ভুল ছিল। লেখা ছিল আত্মসমর্পণের দলিল সই হবে ১৫৩১ (বিকেল ৩.৩১) মিনিটে।
প্রথম আলো: আত্মসমর্পণের দলিলে লেখা এমন কোনো শব্দ বা বাক্যের কথা আপনার মনে পড়ে, যা পাকিস্তানিদের অনুরোধে সংযোজন করা হয়েছিল?
জ্যাকব: না। জেনারেল রাও ফরমান আলি বরং চূড়ান্ত দলিল দেখে বললেন, কে বলেছে, আমরা যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছি। বাংলাদেশ কমান্ডের কাছে আমাদের আত্মসমর্পণের কোনো প্রশ্নই আসে না। বললাম, আমি আপনাদের কাছে যে খসড়া দিয়েছিলাম, তাতে জয়েন্ট কমান্ডই লেখা ছিল। আমি নিয়াজিকে বললাম, এর চেয়ে ভালো শর্ত দিতে আমরা অপারগ। আপনাকে ৩০ মিনিট সময় দিলাম। হয় আপনারা এটি মেনে নিন, অন্যথায় আবার শুরু হতে পারে সংঘাত। তখন ঢাকায় তাদের ২৬ হাজার সেনা। আর ৩০ মাইল দূরে আমাদের তিন হাজার সেনা অপেক্ষমাণ।
প্রথম আলো: আপনার জীবনের সর্বোত্তম মুহূর্ত কোনটি?
জ্যাকব: বেলা পৌনে দুটো। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। স্থান নিয়াজির অফিস। যখন আমি নিয়াজির টেবিল থেকে আত্মসমর্পণের দলিলটি হাতে তুলে নেই। এবং কবরের নৈঃশব্দ ভেঙে বলি, ’আই টেক ইট এ্যাজ একসেপ্টেড।’ অথর্াৎ আমি ধরে নিচ্ছি, পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করল।
প্রথম আলো: আরেকটু বিস্তারিত বলুন।
জ্যাকব: নিয়াজির সামনে যখন দলিলটি দিলাম তখন মনে হলো তিনি তা নাকচ করছেন। আমাকে বলছেন, হোয়াট ডু আই ডু? ২৬,৪০০ পাকিস্তানি সৈন্য তখন ঢাকায়। আর ঢাকার অদূরে আমাদের মাত্র ৩০০০ সৈন্য। আর নিয়াজি কিনা বলছেন, হোয়াট ডু আই ডু? এর উত্তর তো আমার জানা ছিল না। তাঁকে ৩০ মিনিট সময় দিলাম। আমি ঘড়ি দেখছি। পায়চারি করছি। চাপা উত্তেজনায় টগবগিয়ে ফুটছি। তাঁকে বললাম, জেনারেল, এই টেবিলেই সই হবে। আপনি কি মেনে নিলেন? এই দলিল কি গ্রহণ করলেন? নিয়াজি কোনো জবাব দিলেন না। একাদিক্রমে তিনবার আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি নিরুত্তর থাকলেন। হ্যাঁ বা না কোনো ধ্বনিই উচ্চারিত হলো না। তারপরই ঘনিয়ে এল সেই মুহূর্ত। কাগজটি তুলে নিয়ে আচমকা উচ্চারণ করি: আই টেক ইট অ্যাজ অ্যাকসেপ্টেড। আমি ধরে নিচ্ছি, আপনি এটা গ্রহণ করেছেন। আমি অস্কুটে বলে উঠি, থ্যাংক ইউ গড। মনে মনে প্রার্থনা করি, তাঁর কাছে। গড বা আল্লাহ যাই বলি, গড ইজ গড। তিনি আছেন। তিনি নিশ্চয় বাংলাদেশের জনগণের প্রতি করুণাবর্ষণ করছেন। এরপর আমি পাবলিক সারেন্ডার, গার্ড অব অনার ইত্যাদির জন্য চাপ দেওয়া শুরু করি।
প্রথম আলো: নিয়াজি যে কলমটি দিয়ে সই করেন সেটি কার ছিল?
জ্যাকব: আমার ধারণা কলমটি অরোরার ছিল।
প্রথম আলো: ১৬ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠান পরিকল্পনার নায়ক ছিলেন আপনিই?
জ্যাকব: তা জানি না। তবে ঢাকার পতনের পরিকল্পনা আমার। আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া আমার তৈরি। স্থান নির্বাচন করেছি আমি। গার্ড অব অনারও হয়েছে আমার নিজস্ব পরিকল্পনায়। বহু পরে ভেবে দেখেছি, আশ্চর্য, আমার পরিকল্পনায় কোনো ভুল ছিল না। জাতিসংঘের আওতায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবকে আমি রূপান্তর করেছিলাম পাবলিক সারেন্ডারে।
প্রথম আলো: পাক যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যাবাসন ও প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে বলুন।
জ্যাকব: ১৪ দিন পর আমি ফোর্ট উইলিয়ামে ফিরি। আমি তাদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। পাক জেনারেলদের সঙ্গে কথা বলি। তাঁদের সঙ্গে কথোপকথনের বিবরণ আমি দিল্লিতে পাঠাই।
প্রথম আলো: তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
জ্যাকব: প্রত্যেকের একটি অভিন্ন প্রতিক্রিয়া ছিল−আমরা যুদ্ধে হেরে গেছি, কিন্তু এর প্রতিশোধ নেব।
প্রথম আলো: যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাঁদের বিচার না হওয়ার বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
জ্যাকব: দেখুন, আমি আইনজীবী নই। বিচারের প্রশ্নটি ছিল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার। এ ব্যাপারে যত দলিলপত্র তা সবই ছিল বাংলাদেশের হাতে। আমাদের কাছে পাকিস্তানিদের নৃশংসতার বিষয়ে রিপোর্ট ছিল, রেকর্ড ছিল না। আপনাদের ভালো আইনজীবীও ছিল। তবে একাত্তরে ডিসেম্বরের বিজয়ের পরপরই আমাকে কাশ্মীরে বদলি করা হয়। এর পরের ঘটনা আমার জানা নেই।
প্রথম আলো: বাংলাদেশের বিজয়ের ৩৮তম বার্ষিকীতে আপনার মন্তব্য কী?
জ্যাকব: আমি একটি আবেদন জানাই। ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন সমস্যা রয়েছে। আমাদের অবশ্যই একযোগে কাজ করতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে। আমরা বাংলাদেশের প্রতি একদিকে নিরাপত্তার জন্য নির্ভরশীল। দারিদ্র্যের পরে এখন আমাদের অভিন্ন শত্রু হচ্ছে সন্ত্রাস। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় উভয় দেশকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।