Thursday, March 31, 2011

 প্রধানমন্ত্রীতাজউদ্দীন আহমদকে ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি (৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১)


প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি

সূত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-03-31/news/141549




নয়াদিল্লি
ডিসেম্বর ৬, ১৯৭১

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,
৪ঠা ডিসেম্বর তারিখে মাননীয় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আপনি যে বার্তা পাঠিয়েছেন তা পেয়ে আমি ও ভারত সরকারের আমার সহকর্মীবৃন্দ গভীরভাবে অভিভূত হয়েছি। বার্তাটি পেয়ে ভারত সরকার আপনার নিবেদিতপ্রাণ নেতৃত্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য আপনার অনুরোধ পুনর্বিবেচনা করেছে। আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে বিদ্যমান বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে ভারত সরকার স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আজ সকালে এ বিষয়ে পার্লামেন্টে আমি একটি বিবৃতি প্রদান করেছি।
অনুলিপি প্রেরণ করা হলো।
বাংলাদেশের জনগণকে প্রচুর দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। আপনাদের যুবসম্প্রদায় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য এক আত্মোৎসর্গীকৃত সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। ভারতের জনসাধারণও অভিন্ন মূল্যবোধের প্রতিরক্ষায় যুদ্ধ করছে। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে মহান উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই সহমর্মিতা প্রচেষ্টা ও ত্যাগ দুই দেশের মৈত্রীকে আরও সুদৃঢ় করবে। পথ যতই দীর্ঘ হোক না কেন এবং ভবিষ্যতে দুই দেশের জনগণকে যত বড় ত্যাগ স্বীকারই করতে বলা হোক না কেন আমি নিশ্চিত যে জয় আমাদের হবেই।
এই সুযোগে আপনাকে, আপনার সহকর্মীগণকে এবং বাংলাদেশের বীর জনগণকে আমার প্রীতিসম্ভাষণ ও শুভকামনা জ্ঞাপন করছি।
আমি এই সুযোগে আপনার মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের প্রতি আমার সর্বোত্তম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
আপনার একান্ত
(ইন্দিরা গান্ধী)

জনাব তাজউদ্দীন আহমদ
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
মুজিবনগর

ভারতের পার্লামেন্টে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীতাজউদ্দীন আহমদকে ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র

৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভারতের লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিবৃতি

৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভারতের লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিবৃতি

আক্রমণকারীকে প্রত্যাঘাত করতে হবে

সূত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-03-31/news/141543

মাননীয় স্পিকার, আজ সকালে প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী, পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। গতকাল সন্ধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তান বিমানবাহিনী আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে এবং আমাদের বেশ কয়েকটি বিমান ক্ষেত্রের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। সমান্তরালভাবে তাদের স্থলবাহিনীগুলো পশ্চিম সীমান্তজুড়ে আমাদের অবস্থানের ওপর গোলাবর্ষণ করেছে। তাদের প্রচারযন্ত্র সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে এই অভিযোগ প্রচার করছে যে ভারত তাদের ওপর আক্রমণ ও আগ্রাসন শুরু করেছে।
খবরটি আমার কাছে পৌঁছায়, ঠিক যখন আমি কলকাতা ত্যাগ করছিলাম। [দিল্লিতে] ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার সহকর্মী ও বিরোধীদলীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করেছি। আমরা সবাই একমত এবং এই সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি যে জাতির স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে এবং সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে আগ্রাসী আঘাতকারী শক্তিকে প্রত্যাঘাত করতে হবে।
নয় মাসেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকার বর্বরোচিতভাবে দলিত করে চলেছে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি ও মৌলিক মানবাধিকার। তাদের হানাদার বাহিনী যেসব অপরাধ করে চলেছে, প্রতিহিংসাপ্রসূত হিংস্রতার দিক থেকে সেগুলো তুলনাবিহীন। লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে, আমাদের দেশে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এক কোটি মানুষকে। পুরো একটি জাতির এই নিশ্চিহ্নকরণ অভিযানের প্রতি এবং আমাদের নিরাপত্তার ওপর এই হুমকির প্রতি আমরা বারবার বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। সবখানেই মানুষ সহানুভূতি প্রকাশ করেছে, ভারতের ওপর অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বোঝা এবং তার বিপদ উপলব্ধি করেছে।...
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ক্রোধান্ধ হয়ে উঠেছে, কারণ বাংলাদেশের জনগণ এমন কিছু মূল্যবোধের জন্য উঠে দাঁড়িয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে নিবেদিত হয়েছে, যেসব মূল্যবোধ উপলব্ধি করতে সামরিক বাহিনী অক্ষম; এবং সেই সব মূল্যবোধ তারা দলিত করে চলেছে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশেই।
মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ-তৎপরতার সাফল্য যতই বেড়েছে, পাকিস্তানি বাহিনী ততই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আমাদের ঐতিহ্য নিপীড়ক স্বৈরাচারীদের পাশে দাঁড়ানো নয়, বরং নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো; এবং সে কারণেই তাদের রোষানল এখন বর্ষিত হচ্ছে আমাদের ওপর।...
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত আগ্রাসনকে পাকিস্তান বিস্তৃত করেছে ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধরূপে।..আমরা শান্তির পক্ষে, কিন্তু আজ শান্তিই বিপন্ন: শান্তি রক্ষা করতে হবে। আজ আমরা লড়াই করছি জাতীয় ভূখণ্ডের অখণ্ডতা ও জাতীয় মর্যাদা রক্ষার লক্ষ্যে। সর্বোপরি আমরা লড়ছি আমাদের লালিত আদর্শ ও শান্তি রক্ষার স্বার্থে।

বাংলাদেশ ডকুমেন্টস থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে অনূদিত, ঈষৎ সংক্ষেপিত

 কমান্ডারদের নাম (মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১)

কমান্ডারদের নাম

সূত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-03-31/news/141534

দেশরক্ষা মন্ত্রী : তাজউদ্দীন আহমদ
প্রধান সেনাপতি : কর্নেল এম এ জি ওসমানী
চিফ অব স্টাফ : লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ রব
ডেপুটি চিফ অব স্টাফ : গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার
‘জেড’ ফোর্স কমান্ডার : মেজর জিয়াউর রহমান
‘এস’ ফোর্স কমান্ডার : মেজর কে এম সফিউল্লাহ
‘কে’ ফোর্স কমান্ডার : মেজর খালেদ মোশাররফ
সেক্টর নং ১
মেজর জিয়াউর রহমান (এপ্রিল-১০ জুন ’৭১)
মেজর রফিকুল ইসলাম (১১ জুন-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)
সেক্টর নং ২
মেজর খালেদ মোশাররফ (এপ্রিল-অক্টোবর ’৭১)
ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার (অক্টোবর-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)
সেক্টর নং ৩
মেজর কে এম সফিউল্লাহ (এপ্রিল-৩০ সেপ্টেম্বর ’৭১)
মেজর এ এন এম নূরুজ্জামান (১ অক্টোবর-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)
সেক্টর নং ৪
মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত (মে-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)
সেক্টর নং ৫
মেজর মীর শওকত আলী (আগস্ট-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)
সেক্টর নং ৬
উইং কমান্ডার এম কে বাশার (জুন-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)
সেক্টর নং ৭
মেজর খন্দকার নাজমুল হক (এপ্রিল-আগস্ট ’৭১)
মেজর কাজী নূরুজ্জামান (আগস্ট-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)
সেক্টর নং ৮
মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (এপ্রিল-১৫ আগস্ট ’৭১)
মেজর এম আবুল মঞ্জুর (১৮ আগস্ট-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)
সেক্টর নং ৯
মেজর এম এ জলিল (এপ্রিল-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)
সেক্টর নং ১০
কোনো সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়নি। প্রধান সেনাপতি তাঁর নিয়ন্ত্রণে এই বাহিনীকে রেখেছিলেন।
সেক্টর নং ১১
মেজর জিয়াউর রহমান (১০ জুন-১২ আগস্ট ’৭১)
মেজর আবু তাহের (১২ আগস্ট-১৪ নভেম্বর ’৭১)
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লাহ খান (১৫ নভেম্বর-১৬ ডিসেম্বর ’৭১)
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, (২০০৪)।

বাংলাদেশ বাহিনীর জনবল (১৯৭১)

বাংলাদেশ বাহিনীর জনবল

সূত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-03-31/news/141533

‘জেড’ ফোর্স
১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং রওশন আরা ব্যাটারি।
‘এস’ ফোর্স
২য় ও ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
‘কে’ ফোর্স
৪র্থ, ৯ম ও ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং মুজিব ব্যাটারি।
১নং সেক্টর
ক. নিয়মিত বাহিনী: ২,১০০ খ. গণবাহিনী: ২০,০০০
২নং সেক্টর
ক. নিয়মিত বাহিনী: ৪,০০০ খ. গণবাহিনী: ৩০,০০০
৩নং সেক্টর
ক. নিয়মিত বাহিনী: ৬,৬৯৩ খ. গণবাহিনী:২৫,০০০
৪নং সেক্টর
ক. নিয়মিত বাহিনী: ৯৭৫ খ. গণবাহিনী: ৯,০০০
৫নং সেক্টর
ক. নিয়মিত বাহিনী: ১,৯৩৬ খ. গণবাহিনী: ৯,০০০
৬নং সেক্টর
ক. নিয়মিত বাহিনী: ২,৩১০ খ. গণবাহিনী: ১১,০০০
৭নং সেক্টর
ক. নিয়মিত বাহিনী: ২,৩১০ খ. গণবাহিনী: ১২,৫০০
৮নং সেক্টর
ক. নিয়মিত বাহিনী: ৩,৩১১ খ. গণবাহিনী: ৮,০০০
৯নং সেক্টর
ক. নিয়মিত বাহিনী: ৩,৩১১ খ. গণবাহিনী: ৮,০০০
১০নং সেক্টর
এই সেক্টরের কোনো ভৌগোলিক সীমানা ছিল না। বিভিন্ন নদীবন্দর ও শত্রুপক্ষের নৌ-যানগুলোতে অভিযান চালানোর জন্য নৌ-কমান্ডোদের নিয়ে সেক্টরটি গঠিত হয়েছিল। নৌ-কমান্ডোর সংখ্যা ৫১৫ জন।
১১নং সেক্টর
ক. নিয়মিত বাহিনী: ২,৩১০ খ. গণবাহিনী: ২৫, ০০০

তেলিয়াপাড়া সম্মেলন

তেলিয়াপাড়া সম্মেলন

সূত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-03-31/news/141532

১ এপ্রিল ২ ও ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসাররা পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ ও সমন্বয় সাধনের জন্য তেলিয়াপাড়া (হবিগঞ্জ) চা-বাগানে উপস্থিত হন। বিকেলে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভিসি পান্ডে তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাঙালি অফিসাররা ব্রিগেডিয়ার পান্ডের কাছ থেকে কর্নেল এম এ জি ওসমানী (অবসরপ্রাপ্ত) এবং ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে ৪ এপ্রিল কর্নেল ওসমানীসহ ওই এলাকার সব সামরিক অফিসার তেলিয়াপাড়ায় একত্র হয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করবেন। ব্রিগেডিয়ার পান্ডের মাধ্যমে আগরতলায় কর্নেল ওসমানীকে আর রামগড়ে ৮ ইস্ট বেঙ্গলকে আলোচনার সংবাদ জানানো হয়।
৪ এপ্রিল সকাল ১০টায় তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলোতে সভা শুরু হয়। এখানে উপস্থিত হন কর্নেল এম এ জি ওসমানী, লে. কর্নেল সালাউদ্দীন মো. রেজা, লে. কর্নেল আব্দুর রব, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান (অবসরপ্রাপ্ত), মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর সাফাত জামিল, মেজর মাইনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আব্দুল মতিন প্রমুখ। এ ছাড়াও বৈঠকে বিএসএফের ব্রিগেডিয়ার ভিসি পান্ডে, আগরতলার (ত্রিপুরা) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সায়গল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মহকুমা প্রশাসক কাজী রফিকউদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।
সভায় উদ্ভূত পরিস্থিতির সার্বিক মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে বাংলাদেশ সরকার গঠন না হলেও বাস্তবতার প্রয়োজনে সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসারের সদস্য এবং সাধারণ সশস্ত্র জনতাকে নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হবে। কর্নেল ওসমানী মুক্তিবাহিনীর প্রধান থাকবেন। মুক্তিযুদ্ধের সুবিধার্থে বাংলাদেশকে মোট চারটি অঞ্চলে ভাগ করা হবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন মেজর জিয়াউর রহমান (চট্টগ্রাম অঞ্চল), মেজর কে এম সফিউল্লাহ (সিলেট অঞ্চল), মেজর কে মোশাররফ (কুমিল্লা অঞ্চল) এবং মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (কুষ্টিয়া অঞ্চল)। সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয় যে ভারী অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদের অভাব মেটানোর জন্য তাঁরা অবিলম্বে ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করবেন।
এই সভা ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধকালে সামরিক বিষয়সমূহ সমন্বয় সাধনের জন্য প্রথম সভা।

বহু প্রতীক্ষিত সেক্টর কমান্ডারদের সভা

বহু প্রতীক্ষিত সেক্টর কমান্ডারদের সভা

সূত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-03-31/news/141529

জুন মাসের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে যুদ্ধপরিস্থিতি নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এখানে সিদ্ধান্ত হয় যে প্রশাসনিক ও রণকৌশলের সুবিধার্থে রণাঙ্গনকে কয়েকটি অঞ্চল বা সেক্টরে ভাগ করা হবে। মন্ত্রিসভা প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়।
প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী ১১ থেকে ১৫ জুলাই সেক্টর কমান্ডারদের সভা আহ্বান করেন। সভা অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার ৮, থিয়েটার রোডে। সভায় সেক্টর কমান্ডার ছাড়াও সদরদপ্তরের স্টাফ অফিসাররা এবং সেক্টরের বেসামরিক বিষয়ক উপদেষ্টারাও যোগ দেন। শেষ মুহূর্তে সংবাদ পেয়ে তড়িঘড়ি করে হলেও প্রায় সব সেক্টর কমান্ডার ও বেসামরিক বিষয়ক উপদেষ্টা যথা সময়ে কলকাতায় এসে পৌঁছেন। তবে ৫ ও ১০ নম্বর সেক্টরে কমান্ডার এবং ১, ৫ ও ৭ নম্বর সেক্টরের বেসামরিক বিষয়ক উপদেষ্টারা প্রথম দিন অনুপস্থিত ছিলেন। সভা শুরুর আগে ২৮-৩০ জুনের মধ্যে বাংলাদেশ বাহিনীর সদরদপ্তর থেকে বেশ কয়েকটি নীতিনির্ধারণী চিঠি প্রচারিত হয়। এই চিঠিগুলোই সভার আলোচ্যসূচিতে প্রাধান্য পায়।
সভায় আগত সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে কয়েকজন স্বাধীনতাযুদ্ধকে গতি দান এবং যুদ্ধে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে কর্নেল ওসমানীকে দেশরক্ষামন্ত্রী পদে উন্নীত করে যুদ্ধ কাউন্সিলের প্রধান নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া কাউন্সিলে সাতজন সামরিক সদস্য প্রস্তাব করা হয়। সেক্টর কমান্ডারদের অধিকাংশ এই প্রস্তাবের পক্ষে মত পোষণ করেন। মেজর জিয়াউর রহমান এই প্রস্তাবের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিলেও মেজর খালেদ মোশাররফ এর বিরোধিতা করেন। কর্নেল ওসমানী যুদ্ধ কাউন্সিলকে তাঁর একক নেতৃত্বের জন্য হুমকি মনে করে সভার শুরুতেই প্রধান সেনাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। ফলে শুরুর দিন প্রধান সেনাপতি সভায় অনুপস্থিত থাকেন। দেশরক্ষামন্ত্রী তথা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম দিনে সভাপতিত্ব করলেও শুরুতেই ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনার কারণে ওই দিন আলোচনা দীর্ঘায়িত হয়নি এবং প্রধানমন্ত্রীর বড় সময় ব্যয় হয় কর্নেল ওসমানীকে মানিয়ে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করাতে। সভার শুরুতে বেশ কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার উল্লেখ করেন যে ২৮ জুন থেকে প্রচারিত পত্রগুলো তাঁরা পাননি।
সূচনার বিব্রতকর পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে ১২ তারিখ থেকে সভা যথাযথভাবে শুরু হয়। সেক্টর কমান্ডাররা সভায় তাঁদের নিজ নিজ এলাকার বিভিন্ন সাফল্য, সমস্যা ও পরিকল্পনার কথা আলোচনা করেন। একনাগাড়ে পাঁচ দিন সভা চলার পর ১৫ জুলাই সভার সমাপ্তি ঘটে। ১৫ জুলাই রাতে সেক্টর কমান্ডাররা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে শপথ নেন। ১৭ জুলাইয়ের মন্ত্রিসভায় প্রধান সেনাপতি সেক্টর কমান্ডারদের সভার প্রতিবেদন পেশ করেন। ৬ আগস্ট সভার কার্যবিবরণী প্রচার করা হয়, তবে সভায় গৃহীত অনেক সিদ্ধান্তই বিশেষ করে সেক্টর সীমানা, গণবাহিনীর সংগঠন ও অস্ত্রশস্ত্র, গেরিলাযুদ্ধের রণকৌশল ইত্যাদি কার্যবিবরণী প্রকাশের আগেই জুলাই মাসের মধ্যে পৃথক পত্র দ্বারা প্রচারিত হয়।
যুদ্ধকালে এটিই সর্বোচ্চ পর্যায়ের একমাত্র সামরিক সভা, পরবর্তী সময়ে সেক্টর কমান্ডারদের সভা অনুষ্ঠিত হয় দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১১ জানুয়ারি ১৯৭২, ঢাকায়।

সূত্র: লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, রফিকুল ইসলাম
বীর উত্তম, (২০০৬)।
মূলধারা’ ৭১, মঈদুল হাসান, (২০০৮)।

প্রথম সরকারি নির্দেশ (১৯৭১)

প্রথম সরকারি নির্দেশ

সূত্র: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-03-31/news/141527

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম সরকারি নির্দেশের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এতে দেশবাসীর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ছিল:
১. কোন বাঙ্গালী কর্মচারী শত্রুপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন না। ছোট বড় প্রতিটি কর্মচারী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ মোতাবেক কাজ করবেন। শত্রু কবলিত এলাকায় তারা জনপ্রতিনিধিদের এবং অবস্থা বিশেষে নিজেদের বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করবেন।
২. সরকারী, আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের যে-সমস্ত কর্মচারী অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁরা স্ব স্ব পদে বহাল থাকবেন এবং নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করবেন।
৩. সকল সামরিক, আধা সামরিক লোক কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত অবিলম্বে নিকটতম মুক্তিসেনা শিবিরে যোগ দেবেন। কোন অবস্থাতেই শত্রুর হাতে পড়বেন না বা শত্রুর সাথে সহযোগিতা করবেন না।
৪. যে কেউ শত্রুপক্ষকে খাজনা-ট্যাক্স দেবে, অথবা এ ব্যাপারে সাহায্য করবে, বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী তাদেরকে জাতীয় দুশমন বলে চিহ্নিত করবে এবং তাদের দেশদ্রোহের দায়ে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবে।
৫. যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিশেষ করে নৌ-চলাচল সংস্থার কর্মচারীরা কোন অবস্থাতেই শত্রুর সাথে সহযোগিতা করবেন না। সুযোগ পাওয়া মাত্রই তাঁরা যানবাহনাদি নিয়ে শত্রুকবলিত এলাকার বাইরে চলে যাবেন।
৬. কালোবাজারী, মুনাফাখোরী, মজুদদারী, চুরি, ডাকাতি বন্ধ করতে হবে; এদের প্রতি কঠোর নজর রাখতে হবে।
৭. গ্রামে গ্রামে রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিবাহিনীর নিকটতম শিক্ষাশিবিরে রক্ষীবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠাতে হবে।
৮. শত্রুপক্ষের গতিবিধির সমস্ত খবরাখবর অবিলম্বে মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রে জানাতে হবে।
৯. স্বাধীন বাংলা মুক্তিবাহিনীর যাতায়াত ও যুদ্ধের জন্য চাওয়া মাত্র সমস্ত যানবাহন (সরকারী/বেসরকারী) মুক্তিবাহিনীর হাতে ন্যস্ত করতে হবে।
১০. বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী অথবা বাংলাদেশ সরকার ছাড়া অন্য কারো কাছে পেট্রল, ডিজেল, মবিল ইত্যাদি বিক্রি করা চলবে না।
১১. কোন ব্যক্তি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অথবা তাদের এজেন্টদের কোন প্রকারের সুযোগ-সুবিধার সংবাদ সরবরাহ অথবা পথনির্দেশ করবেন না। যে করবে, তাকে আমাদের দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে এবং প্রয়োজনবোধে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
১২. শত্রুবাহিনীর ধরা পড়া সমস্ত সৈন্যকে মুক্তিবাহিনীর কাছে সোপর্দ করতে হবে।

‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এবং সাপ্তাহিক জয় বাংলা, ১১ই মে ’৭১ সংখ্যায় মুদ্রিত।’