Saturday, February 7, 2009

গুয়ানতানামোয় মোবারকের বন্দিজীবন

প্রকাশ: প্রথম আলো, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৯

গুয়ানতানামোয় মোবারকের বন্দিজীবন
টিপু সুলতান ও বদর উদ্দিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফিরে



�রাক্ষসের মতো কুকুরগুলোর শেকল একটু ঢিলা হলেই বুকটা ধক করে উঠত। এই বুঝি ছিঁড়ে-ছুড়ে খেয়ে ফেলবে। সেনারা টয়লেটের কমোডের ভেতর মুখ চেপে ধরে ফ্লাশ করে দিত। নাকে-মুখে ঢুকে যেত ময়লা। নগ্ন করে শুইয়ে রাখত বরফের মতো ঠান্ডা মেঝেতে। আবার কখনো কখনো পাথরের কঙ্করের ওপর উপুড় করে মুখ চেপে ধরত। জীবনের অনেক কিছুর বর্ণনা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু গুয়ানতানামো বন্দিশিবিরে নির্যাতনের বর্ণনা দেওয়া কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এ যেন সাক্ষাৎ দোজখ।� এই বর্ণনা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মজলিশপুর ইউনিয়নের মৈন্দ গ্রামের মোবারক হোসেন বিন আবুল হাশেমের। কিউবার দক্ষিণ-পূর্ব পাশে ক্যারিবীয় সাগরে অবস্থিত গুয়ানতানামো বে-তে যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত কারাগারে পাঁচ বছর বন্দী ছিলেন তিনি। ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার দুই মাসের মাথায় পাক-আফগান সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন বাংলাদেশি নাগরিক মোবারক। ২০০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি সেখান থেকে ছাড়া পান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বিশ্বব্যাপী বিতর্কিত গুয়ানতানামো কারাগারটি বন্ধ করে দেন। এই খবরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোবারক খুশি। সম্প্রতি মৈন্দ গ্রামের নিজ বাড়িতে প্রথম আলোর কাছে পাঁচ বছরের বন্দিজীবনে রোমহর্ষক নির্যাতনের বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি এ জন্য বারাক ওবামাকে অভিনন্দনও জানান। মোবারক প্রথম আলোকে বলেন, গুয়ানতানামোয় তাঁর একেকটা দিন যেন ছিল একেকটা বছর। হাতে-পায়ে শিকল বাঁধা থাকত। কারও কোনো নাম ছিল না। পরিচয় বলতে হাতে বাঁধা ব্যান্ডে লেখা কয়েদি নম্বর। এই নম্বর ধরে ডাকা হতো। তাঁর নম্বর ছিল ১৫১। মোবারক বলেন, �কারাগারে দায়িত্বরত মার্কিন সেনারা ডাকত �ওয়ান ফিফটি ওয়ান� বলে। আর ডাক পড়া মানেই আবার নগ্ন করে তল্লাশি, নতুন নতুন কায়দায় নির্যাতন। সেসব নির্যাতনের কথা মনে হলে এখনো অাঁতকে উঠি।� মার্কিন সেনাদের মূল জিজ্ঞাসা ছিল, কেন আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন মোবারক। মোবারকের পাকিস্তান গমন: মোবারক ঢাকার মোহাম্মদপুর জামেয়া রহমানিয়া মাদ্রাসায় পড়তেন। ১৯৯৮ সালে তিনি ও তাঁর চাচা গিয়াস উদ্দিন ঢাকার এক মাওলানার সহায়তায় পর্যটন ভিসায় পাকিস্তানে যান এবং নিউ করাচির জামিয়া আনোয়ারুল কোরআন মাদ্রাসায় ফিকহশাস্ত্রে (ইসলামি আইন) ভর্তি হন। সেখানে তাঁরা তিন বছর লেখাপড়া করেন। ঢাকার যে মাওলানার মাধ্যমে মোবারক পাকিস্তানে গিয়েছিলেন, তাঁর নাম তিনি ভুলে গেছেন বলে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন। মোবারকের বাবা আবুল হাশেম ওরফে আবু হাশিম ২০০৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মাধ্যমে তিনি প্রথমে জানতে পারেন, তাঁর ছেলে গুয়ানতানামোয় বন্দী আছেন। মোবারকের বাবা ঢাকার সাতমসজিদ রোডে গ্রাফিক আর্ট কলেজ মসজিদের ইমাম। আফগানিস্তানে কেন: মোবারক প্রথম আলোকে জানান, ২০০১ সালের ডিসেম্বরে রোজার মাসের শেষ দিকে তিনি করাচি থেকে কোয়েটা যান। সেখান থেকে বুলদাগ সীমান্ত দিয়ে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে তাঁর বন্ধুর বাড়ি যান। তাঁর এই আফগান বন্ধুর নাম রফিকুল ইসলাম। সেখানে তিনি চার দিন থাকেন। তখন তো তুমুল যুদ্ধ চলছিল। ওই অবস্থায় আফগানিস্তানে গেলেন কেন? জবাবে মোবারক বলেন, সাহাবিদের কবর জিয়ারত করা ছিল তাঁর বড় উদ্দেশ্য। তাঁর বন্ধু তালেবান সরকার পতনের পর যেতে বলেছিল। মোবারকের দাবি, মার্কিনবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিতে তিনি কাবুলে যাননি। সেখানে কোন কোন সাহাবির কবর আছে জানতে চাইলে মোবারক বলেন, �বেশ কয়েকজন সাহাবির কবর আছে। কয়জনের কথা বলব।� তিনি জায়গার নামও বলতে পারেননি। যেভাবে গ্রেপ্তার: মোবারক দাবি করেন, চার দিন পর কাবুল থেকে জালালাবাদ হয়ে পেশোয়ার সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানে ঢোকেন। সেদিন ছিল ঈদ। সীমান্ত থেকে ৩০ মিনিটের হাঁটা পথ পেরিয়ে একটি মসজিদ পান। সেখানে ফজর নামাজ শেষে এক যুবকের কাছে করাচি যাওয়ার সহজ পথ জানতে চান। যুবক জানালেন, তিনিও করাচি যাচ্ছেন। মোবারক চাইলে ওদের গাড়িতে যেতে পারেন। পরে ওই যুবক গাড়ি নিয়ে একটি থানায় ঢোকেন এবং মোবারককে পুলিশে হস্তান্তর করেন। সেখানে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কোহাট কারাগারে। দুই সপ্তাহ পর তিনিসহ আরও আট-নয়জনকে সামরিক ট্রাকে করে পেশোয়ার বিমানবন্দরে নিয়ে মার্কিন সেনাদের হাতে তুলে দেয় পাকিস্তানের গোয়েন্দারা। মোবারক বলেন, তারপর একটি হেলিকপ্টারে করে তাঁদের আফগানিস্তানের কান্দাহারে আমেরিকার সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। কান্দাহার থেকে নির্যাতন শুরু: �হেলিকপ্টার থেকে নামিয়ে চোখ খুলে দেওয়া হয় বন্দীদের। জামা-কাপড় ছুরি দিয়ে কেটে খুলে নেওয়া হয়। সবাই তখন নগ্ন। চুল, দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে ফেলা হয়। এরপর আচমকা শুরু করে মারধর। তুলে আছাড় মারা। মনে হচ্ছিল মেরে ফেলবে। কলেমা পড়লাম। কখন যে হুঁশ হারালাম জানি না। হুঁশ আসার পর দেখি, একটি লোহার বড় কনটেইনারের ভেতর আছি। সঙ্গে বাকিরাও। তারা আরব ও আফগান। খাওয়া-পানি ছাড়া এভাবে এক দিন পার হলো। শরীর ফুলে ব্যথায় টনটন করছিল। একজন দোভাষী এসে বলে গেল, কেউ কারও সঙ্গে কথা বলতে পারবে না।� মোবারক বলে যান, �এক দিন পর আমাদের একটি তাঁবুতে নেওয়া হয়। এক তাঁবুতে ২০ জন বন্দী। খাবার জনপ্রতি সকালে অর্ধেক রুটি, এক মগ চা। বিকেলেও একই খাবার। খাবার দিলেও ঘুমাতে দেয়নি তারা। চোখ বন্ধ করলেই সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার−ওয়েক আপ (ঘুম থেকে ওঠ্)। প্রথম প্রথম শব্দটার অর্থ বুঝতাম না। তখন সেনারা এসে লাথি মেরে তুলে দিত�−বললেন মোবারক। তারপর গুয়ানতানামো: দুই সপ্তাহ পর মোবারকদের ২০ জনকে চোখ বেঁধে একটি বিমানে তোলা হয়। হাত-পাও শিকলে বাঁধা। মাঝখানে একবার বিমান বদল হয়। তারপর গুয়ানতানামো কারাগারে। পৌঁছানোর পর সবার নাম-ঠিকানা লেখা হয়। আঙ্গুলের ছাপ নেওয়া হয়। মোবারকের ভাষায়, �সবার হাতে ব্যান্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়। তাতে কয়েদি নম্বর লেখা। আমার নম্বর ১৫১। এটাই ছিল আমার পরিচয়।� �তারপর সবাইকে মাঠে নগ্ন দাঁড় করানো হয়। তারপর শিকলে বাঁধা বড় বড় কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়। শিকলের এক প্রান্ত সেনাদের হাতে। ঘেউঘেউ শব্দে শরীর হিম হয়ে আসে। গায়ের কাছে এসে কুকুর এমনভাবে লাফায়, বুঝি, নাগাল পেলে খেয়ে ফেলবে। পেছনে সরার উপায় নেই। হাত-পা বাঁধা।� মোবারক বলে যান, �কিছুক্ষণ পর অন্য একদল সেনা এসে শুরু করল মারধর। হুঁশ ফেরার পর দেখি নাকে-মুখে রক্ত। শরীর ফুলে ডোল। তারপর গোসল করিয়ে সবাইকে আলাদা সেলে রাখা হয়। দেওয়া হয় প্যাকেট করা শুকনা খাবার।� মোবারক জানান, প্রথমে তিনি একাকী এক সেলে ছিলেন আড়াই মাসের মতো। মাঝে মাঝে সেনারা তল্লাশি করত। তিনি বলেন, �সেলে একটি কম্বল আর টয়লেটের কাজের জন্য দেওয়া একটি প্লাস্টিকের বালতি ও মগ ছাড়া কিছু ছিল না; তবুও তল্লাশি চলত। তল্লাশির সময় আরেক দল সেনা এসে আমাদের বাইরে নিয়ে নগ্ন করে মারধর করত। আড়াই মাস পর এই আজাব শেষ হয়। কিন্তু নিয়ে যায় আরেক দোজখে। তার নাম ক্যাম্প ডেল্টা। হিম ঠান্ডা ঘর। কাপড় নেই, কম্বল নেই; খালি গা। মনে হতো ওই ঠান্ডা ঘরের চেয়ে আগের দোজখ অনেক ভালো ছিল।� ঠান্ডা ঘরে এক মাস রাখার পর মোবারকদের নেওয়া হয় আরেকটি নির্যাতন সেলে। এক মাস পর সেখান থেকে অন্য ব্লকে। লম্বা সেল। তিন দিক খোলা। কাঁটাতারে ঘেরা। প্রতিটি সেলে দুটি সারিতে ৪৮ জন বন্দী। সবাইকে পরানো হয় গাঢ় কমলা রঙের পোশাক। হাতে-পায়ে শিকল। সেখানে মোবারকেরা প্রথম রান্না করা খাবার পান। মোবারক জানান, �এখানে আসার পর নির্যাতন নতুন মাত্রা পায়। এবার শুধু শারীরিক নয়, মানসিক পীড়নও চলত। কয়েক দিন পর পর একেকজনের ডাক পড়ত। জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলত নানা নির্যাতন। কঙ্করওয়ালা মাঠে আছড়ে ফেলে মুখ চেপে ধরা হতো। পাথরের আঘাতে রক্ত বের হয়ে আসত। হাত-পা এমনভাবে মোচড়াত যেন ভেঙে ফেলবে। কত রকম নির্যাতনের কথা বলব। এসব মনে পড়লে এখনো অাঁতকে উঠি।� মোবারক এখন: মোবারকের শরীর এখনো পুরোপুরি ভালো হয়নি। হাত-পায়ের জোড়ায় জোড়ায় প্রায়ই ব্যথা করে বলে জানান তিনি। ২০০৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর মুক্তি পান মোবারক। দুই দিন পর মার্কিন বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে তাঁকে ঢাকায় পাঠানো হয়। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর আল-কায়েদার সঙ্গে জড়িত এবং এ দেশের জঙ্গিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার সন্দেহে বিমানবন্দর থানার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে তিন দিনের রিমান্ডে নেয়। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে পাসপোর্ট আইনে মামলা হয়। আদালতে থেকে জামিন নিয়ে তিনি ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে থেকে মুক্তি পান ২০০৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। মোবারকের বয়স এখন ৩৭ বছর। দেশে এসে তিনি বিয়ে করেন। তাঁর পাঁচ মাসের একটি কন্যা সন্তান আছে। থাকেন গ্রামে। বাড়ির পাশে হাফেজ আবদুর রউফ মদীনাতুল উলুম নুরানী মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। আরও দুই বাঙালি: মোবারক জানান, গুয়ানতানামোয় তিনি আরও দুজন বাঙালির দেখা পেয়েছিলেন। তাঁরা খুব অল্পদিন একই সেলে ছিলেন। একজনের নাম রহুল আহমেদ। সিলেটে আদি বাড়ি হলেও তিনি ব্রিটিশ নাগরিক। আরেকজনের বাড়ি ফেনী। তাঁর নাম মোবারকের মনে নেই। এই দুজনের ভাগ্যে কী হয়েছে, মোবারক জানেন না। প্রসঙ্গত যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশি ওই বন্দীর নাম মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন। জন্ন ১৯৬৭ সালের ১ জানুয়ারি ফেনীতে। কিছু প্রশ্ন: মোবারক গ্রেপ্তার হওয়া ও আফগানিস্তানে যাওয়ার যে কারণ বলেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ২০০৬ সালে মার্কিন সরকার গুয়ানতানামো বন্দীদের আংশিক তালিকা প্রকাশ করে। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর খবর অনুযায়ী, মোবারক আফগানিস্তান থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ছাড়া তুমুল যুদ্ধের মধ্যে অচেনা পথে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। মোবারকের ভাষ্য অনুযায়ী, যাওয়ার আগে বন্ধুর সঙ্গে কোনোভাবে যোগাযোগ হয়নি, কোনো দিন আফগানিস্তানে যাননি। একা একা শুধু ঠিকানা ধরে এক সীমান্ত দিয়ে যাওয়া, আবার আরেক সীমান্ত ধরে পাকিস্তান ফেরার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি মোবারক। তবে সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, মোবারক আফগানিস্তানে আরব মুজাহিদদের একটি ক্যাম্পে বাবুর্চির কাজ করতেন।