প্রকাশ: দৈনিক প্রথম আলো, বিজয় দিবস বিশেষ সংখ্যা, ১৬-১২-২০০৮
‘বাংলাদেশ যুদ্ধের বন্দীরা’: যে যুদ্ধের শেষ নেই
ফারুক ওয়াসিফ
যুদ্ধের মধ্যে একজন সৈনিকের সামনে চারটি সম্ভাবনা থাকে: অক্ষত অবস্থায় জয়, আহত হওয়া, রণাঙ্গনে মৃত্যুবরণ এবং যুদ্ধবন্দী হওয়া। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন অনিল আথালে’র ভাগ্যে শেষেরটিই বরাদ্দ ছিল। ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারতের পাঞ্জাব সীমান্তে নিয়তি পাকিস্তানি সৈনিকের চেহারায় এসে তাঁকেসহ তাঁর ছয় সহযোদ্ধাকে বন্দী করে। পরের কাহিনীতে তাই যুদ্ধের উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ নেই। রয়েছে জেল থেকে জেলে আটক থাকার দুঃসহ স্মৃতি।
ভারতের এ রকম আরও দুই হাজার ৩০৭ জন যুদ্ধবন্দী সৈনিকের মধ্যে স্থান হয় তাঁর। এঁদের কেউ কেউ আটক হন বাংলাদেশের রণাঙ্গনে, তবে বেশির ভাগই বন্দী হন ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে।
এর ঠিক ১১ দিন পর পূর্ব রণাঙ্গনে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা ও বেসামরিক নাগরিককে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অস্ত্র সমর্পণ করে যুদ্ধবন্দীর ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়। শুরু হয় দুই হাজার ৩০৭ বনাম ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের কূটনৈতিক খেলা। আর তাতে জড়িত হয়ে যায় বাংলাদেশে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নও। কেননা, ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আলাদা একটি যুদ্ধ হলেও বাংলাদেশকে ঘিরে তা হওয়ায় এই যুদ্ধবন্দীদের পরিচয় দাঁড়ায় ‘বাংলাদেশ যুদ্ধের বন্দী’।
বন্দীস্মৃতি
ছয় গুর্খা সৈন্যের সঙ্গে অনিল সীমান্তে টহল দিচ্ছিলেন। হঠাৎ পাকিস্তানি সৈন্যরা সেই এলাকায় আক্রমণ চালায়। বোমা ও গুলির মধ্যে তাঁরা এক পাথুরে এলাকায় আটকে পড়েন এবং বন্দী হন। দুর্ভাগ্যের সেই শুরু। অনিলের কথায়, ‘চূড়ান্ত বিপদ আর চাপের স্মৃতি মানুষ কখনো ভোলে না। এখনো মনে হয় ওসব যেন গতকালের কাহিনী।’
তাঁদের চালান করা হয় রাওয়ালপিন্ডির সেনাসদর দপ্তরে। সেই দলে তিনিই ছিলেন একমাত্র কর্মকর্তা। বাকিরা ‘জওয়ান’। জেরার সময় পাকিস্তানিরা দ্রুতই বুঝে ফেলে এঁর কাছ থেকে কিছু জানা যাবে না। ক্যাপ্টেন অনিলের মতো পদাতিক বাহিনীর লোকদের কাছে আসলে কোনো কৌশলগত নিরাপত্তা তথ্য থাকে না। ‘কেঁচো যেমন তার সামনের মাটিই দেখে, একজন পদাতিকের নজর তেমনি কেবল তার অবস্থানের চারপাশের কয়েক মাইলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ রকম তথ্য শত্রুর কোনো কাজেই লাগে না’।
১৫ দিনের মধ্যেই তাঁকে পাঠানো হয় রাওয়ালপিন্ডি জেলের ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত কক্ষে। বন্দীদের আত্মহত্যা ঠেকাতে সেসব কক্ষের ছাদ রাখা হতো উঁচুতে, ঘরে থাকত না কোনো আসবাব। সেখানে বসে শুনতে পেতেন অন্য কোনো সেল থেকে স্লোগান আসছে, ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’। কারা ওরা? ভারতীয়, বাঙালি? কারা? পরে জানা যায়, ওরা বেলুচ। বাংলাদেশে পাকিস্তানি দখলদারির সময় পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের জনগণও স্বাধিকারের দাবিতে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। বাংলাদেশে যখন গণহত্যা চলছে, তখন খোদ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচ নেতা-কর্মীদের ধরে ধরে জেলে পোরা হচ্ছে।
প্রথম দিকে রাত হলে বিমানের আওয়াজ আসত। পাকিস্তানের আকাশে ভারতীয় বিমান? আশায় রোমাঞ্চিত হয়ে উঠতেন অনিল। তাঁর সেলের ছাদেই বিমানবিধ্বংসী বন্দুক বসানো। অনিলের আশা সেখানে বোমা পড়লেই তিনি পালাবেন। তাই বিমানের আওয়াজ পাওয়ামাত্রই বুট পরে বসে থাকতেন।
একদিন আর বিমানের আওয়াজ এল না। কয়েক দিন সব চুপচাপ। তারপর আগমন ঘটল এক মেজরের। রাতের পর রাত না ঘুমানোর ছাপ তাঁর চোখে-মুখে। তিনি অনিলকে জিজ্ঞেস করেন, ‘রাওয়ালপিন্ডি শহর দেখেছ?’ দেখার তো উপায় ছিল না। জেলে আনার পথে অনিলদের তো চোখ ছিল বাঁধা। উত্তর না আসায় খেপে গিয়ে মেজর বলেন, ‘চিন্তা কোরো না, একদিন এখানে বিজয়ীর বেশে তোমরা আসবে। তখন মন ভরে দেখো।’
বিদ্যুৎ চমকে গেলে অনিলের মনে। যুদ্ধ শেষ? পাকিস্তান পরাজিত হয়েছে! মুক্তি কি আসন্ন?
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষাশেষি কোনো এক দিন। জেলের বাইরে দিয়ে বিরাট এক মিছিলের আওয়াজ আসে। তারা স্লোগান দিচ্ছে, ‘ভুট্টো জিন্দাবাদ’। ঘণ্টাখানেক পর সেই মিছিল ফিরে আসে নতুন স্লোগান নিয়ে, ‘হামারা নয়া সর্দার ভুট্টো জিন্দাবাদ’। সেই রাতেই জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট হন। কিন্তু অনিল জানতেন না, আরও কয়েক বছর পর তাঁর আশপাশের কোনো সেলেই ভুট্টো পার্শ্ববর্তী প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ থেকে বন্দী হয়ে আসবেন। এবং তারও কিছুদিন পর সেখানেই তাঁকে ফাঁসি দেবেন আরেক জেনারেল জিয়াউল হক।
বাহাত্তর সালের ফেব্রুয়ারি মাস। অনিলদের সরিয়ে নেওয়া হয় লায়ালপুরে (তৎকালীন ফয়সালাবাদ জেল) যুদ্ধবন্দীদের জন্য নির্ধারিত শিবিরে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শেষ হলেও উভয় দেশের যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির মুহূর্ত আর আসে না। বাংলাদেশ কোনোভাবেই যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্ণিত করে বিচার শুরু না করে বিষয়টির ফয়সালা করতে রাজি নয়। এভাবে শুরু হয় উভয় দেশের যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির কূটনৈতিক যুদ্ধ।
লায়ালপুরের জীবন
লায়ালপুর যুদ্ধবন্দী শিবিরের দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ লতিফ মালিক। একদিন তিনি কয়েকজন বন্দী ভারতীয় কর্মকর্তাকে শিবিরটি ঘুরে দেখান। সেটা এক মারাত্মক জেলখানা। পরপর ১০ ফুট উঁচু তিনটি দেয়ালের চক্কর দিয়ে ঘেরা। জায়গায় জায়গায় ওয়াচপোস্টে মেশিনগানধারী প্রহরী, সার্চলাইট ও শিকারি কুকুর। ওই চিত্র যে দেখেছে, পালানোর সাধ তার উবে যাবে। কর্নেল লতিফ তাই ঠাট্টার সুরে বলতে পারেন, ‘তোমাদের পালানোর অধিকার রয়েছে, যেমন আমাদেরও অধিকার রয়েছে ধরা পড়লে গুলি করে মারার।’ সেখানেই বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের ঘৃণার মাত্রাটা বুঝতে পারা যায়। এক পাকিস্তানি কর্মকর্তা তো বলেই ফেলে, ‘পাকিস্তানি সৈন্যরা যে বাংলাদেশের বদলে ভারতের হাতে বন্দী এতে আমরা খুশি।’ বাংলাদেশ নাকি তাদের জন্য বোঝা ছিল। বোঝা নেমে যাওয়ায় এখন তারা নাকি খুশি।
সিমলা চুক্তি
দেখতে দেখতে চলে আসে বাহাত্তর সালের জুলাই মাস। খবর আসে ইন্দিরা গান্ধী ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে সিমলা চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। তার মানে মুক্তি?
কিন্তু আশার ফুলে তখনো কাঁটা ছিল। বাংলাদেশ যুুদ্ধবন্দীদের মধ্যে চিহ্ণিত ২০০ যুদ্ধবন্দীর মুক্তির বিষয়টি মানতে নারাজ। ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল এ বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি সমঝোতাও স্বাক্ষরিত হয়। যাহোক, একসময় বিষয়টির আপাত সমাধানও হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো একতরফাভাবে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দেন। বিনিময়ে ভারতও ঘোষণা দেয় যে এ মুহূর্তে কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের রণাঙ্গনে আটক হওয়া পাকিস্তানি সৈন্যদের মুক্তি দেওয়া হবে। অনিলদের ভাগ্যের সুখপাখি সেদিনই ডানা মেলল। তাঁরা মুক্ত হলেন। তারিখ ১ ডিসেম্বর ১৯৭২।
কিন্তু বাংলাদেশে আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের মুক্তি পেতে লেগে যায় আরও তিনটি বছর। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি ও প্রত্যাবর্তন বিষয়ে দিল্লিতে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয় ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল। সেই চুক্তির বলে ১৪ নভেম্বর তারা মুক্ত হয়। তাদের মধ্যে ছিল কয়েক শ বাঙালি রাজাকারও।
যে যুদ্ধের শেষ নেই
একাত্তরের যুদ্ধবন্দীদের কথা সবাই যখন ভুলতে বসেছে, তখন হঠাৎ সামনে চলে আসে নাসিরের কথা। তাঁর আদি নিবাস ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের গাজিপুরে। একাত্তরের বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটক হন পাকিস্তানি নাগরিক নাসির উদ্দীন। স্বাধীনতার পর তাঁকে হস্তান্তর করা হয় ভারতীয়দের হাতে। তারপর বহুবছর কেউ তাঁর খোঁজ করেনি। যেন নাসির নামে কেউ কখনো ছিল না। কিন্তু ২০০৮ সালে কলকাতার আলিপুর জেল থেকে ছাড়া পাওয়া এক কয়েদি পুরোনো ইতিহাস ধরে টান দেন। মুক্তি পেয়েই তিনি গাজিপুরে নাসিরের আত্মীয়দের কাছে খবর পাঠান: নাসির বেঁচে আছে, ২০০০ সালে তাঁকে শেষ দেখা গেছে আলিপুর জেলে। খবর যায় করাচিতে বসবাসরত নাসিরের ছেলে হোসাইনের কাছে।
হোসাইনরা মেনে নিয়েছিল যে তাদের বাবা মারা গেছেন। কিন্তু নতুন খবরে আবার শুরু হলো তাদের দহন। কীভাবে তারা ফিরে পাবে ৩৭ বছর আগের যুদ্ধবন্দী নাসিরকে? একই প্রশ্ন ভারতের সুমন পুরোহিতের, ‘আমার বিয়ের ১৮ মাস পরে, আমার ছেলে বিপুলের জন্নের তিন মাসের মাথায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের পঞ্চম দিনে আমার স্বামী বিমান নিয়ে পাকিস্তানে হামলা চালাতে গিয়ে নিখোঁজ হন।’ তখন সুমনের বয়স ছিল ২৩ বছর, এখন ৫৯। ৩৭ বছর ধরে তিনি খুঁজে চলেছেন তাঁর স্বামীর সন্ধান। নানান সময়ে খবর আসে, কেউ নাকি তাঁকে দেখেছে পাকিস্তানের কারাগারে। বিভিন্ন বইপত্রেও এ রকম ইঙ্গিত মেলে। এ রকম আরও ৫৪ জন নিখোঁজ ভারতীয় সৈনিকের পরিবারের সদস্যরা এখানে-ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছে−যদি স্বজনের খোঁজ মেলে, যদি তার দেখা মেলে!
এই খোঁজাখুঁজির দৌড়ে ছুটতে ছুটতে ওই ৫৪ জনের পরিবার মিলে একটি সংগঠনও বানিয়েছে। তাদের কাজ নিখোঁজ যুদ্ধবন্দীদের হদিস বের করা এবং তাদের মুক্ত করার জন্য তদবির করা। পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলেও তারা ঘুরে বেড়িয়েছে।
তিনটি জেলে খোঁজা শেষ করে বৃদ্ধ সুমন এখন তরুণী বয়সে হারানো তাঁর তরুণ স্বামীকে খঁুজতে যাবেন লাহোর জেলে। সেখানে না পেলে রাওয়ালপিন্ডি অথবা লায়ালপুরে অথবা অন্য কোথাও। ‘আমি খুঁজবই। খঁুজে না পেয়ে জেল গেট দিয়ে হেঁটে বের হয়ে আসা অসহ্য লাগে। মনে হয় আর পারব না, কিন্তু আশা আমাকে পাথরের মতো শক্ত করেছে।’
ওদিকে পাকিস্তানের করাচি থেকে নাসিরের ছেলে হোসাইনও কলকাতায় আসছে তার বাবাকে খঁুজে বের করতে। এ রকম কত হোসাইন আর কত সুমন বুকে পাথর বেঁধে ছুটে বেড়াচ্ছে কোনো বিস্মৃত যুদ্ধবন্দীকে মুক্ত করার জন্য। সেই ছোটাছুটির মধ্যে কোনো জেলে বা কোনো সীমান্তে একদিন হয়তো তাদের দেখাও হয়ে যাবে। সেই দেখাদেখির মধ্যে কোনো শত্রুতা থাকবে কি? যে যুদ্ধের বন্দী তাদের বাবা ও স্বামী, সেই যুদ্ধ তো অনেক আগেই শেষ। কিন্তু তাদের লড়াই বুঝিবা এখনো শেষ হয়নি। তাদের আত্মীয়রা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে বন্দী হয়েছিল। কিন্তু আপনজনকে মুক্ত করার লড়াইয়ে আজ তারা এক। সেই লড়াইয়ে তারা আর ভারতীয় বা পাকিস্তানি নয়; তারা সহযোদ্ধা। তারা যুদ্ধবন্দীদের স্বজন। অন্যদিকে কোনো এক অজ্ঞাত কারাকক্ষে কোনো একজন পুরোহিত বা নাসির অপেক্ষা করেন−একদিন ডাক আসবে মুক্তির। দেয়ালের গায়ে দাগ কেটে কেটে তাঁরা হয়তো বছর পেরোনোর হিসাব রাখেন। কত বছর পেরোল? দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে তাঁরা গোনা শেষ করেন: ৩৭ বছর!
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment