Monday, July 28, 2008

সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিঃ বাংলাদেশ যদি তলিয়ে যায়...

প্রকাশঃ প্রথম আলো, ১১ই এপ্রিল, ২০০৮; সম্পাদকীয় পাতায়

খোলা চোখে
বাংলাদেশ যদি তলিয়ে যায়...
হাসান ফেরদৌস

আফসান চৌধুরী নির্মিত একটি তথ্যচিত্রের নাম ‘ডাজ এনিবডি কেয়ার ইফ বাংলাদেশ ড্রাউনস?’ যাঁরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন, ইউটিউব ওয়েবসাইটে ছবিটি দেখতে তাঁদের পরামর্শ দেব। ভু-উপরিভাগের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বা সি-লেভেল বেড়ে যাবে, তার ফলে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকুলবর্তী ও নিচু বিস্তীর্ণ অঞ্চল আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তথ্যচিত্রটি এই সমস্যাকে ঘিরে। আফসানের কথামতো, বাংলাদেশের জন্য ভুভাগে তাপমাত্রা বৃদ্ধি কোনো তাত্ত্বিক ব্যাপার নয়। এ নিয়ে ‘যদি’ বা ‘কিন্তু’ বলার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকুলবর্তী কোনো কোনো এলাকা ইতিমধ্যে তলিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। সমুদ্র এখন অনেক কাছে চলে এসেছে। প্লাবিত এলাকা ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ দল বেঁধে ঘর ছাড়তে শুরু করেছে। সরেজমিন তদন্ত শেষে আফসানের প্রশ্ন, যদি বাংলাদেশ সত্যি সত্যি ডুবে যায়, তাতে পৃথিবীর কার কী এসে যায়?
পৃথিবীর কী এসে যায় জানি না, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এ যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনিতেই আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। শহরগুলোতে পা রাখার জায়গা নেই, মানব বসতি বেড়ে যাওয়ায় কৃষিক্ষেত্রের পরিমাণও কমে আসছে। এর ওপর যদি আমরা আরও কৃষিভুমি হারিয়ে ফেলি, তাহলে সমস্যা কী রকম জটিল হবে, তা বোঝা কঠিন নয়। আমাদের দেশ কতটা ঘনবসতিপূর্ণ তা আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায়। আমেরিকার মোট জনসংখ্যা ৩০ কোটি, কিন্তু তার আয়তন ৯৮ লাখ ৩০ হাজার (৯.৮৩ মিলিয়ন) বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে বাংলাদেশের আয়তন মোটে ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার, কিন্তু তার জনসংখ্যা আমেরিকার ঠিক অর্ধেক। আয়তনের দিক দিয়ে আমাদের দেশ আমেরিকার অঙ্গরাজ্য আইওয়ার কাছাকাছি, কিন্তু সে রাজ্যের জনসংখ্যা মোটে তিরিশ লাখ। মার্কিন সাংবাদিক মার্ক হার্টসগার্ড গত বছর বাংলাদেশের ব্রਜ਼পুত্রের পাড়ে অন্তরপাড়া নামের এক গ্রাম ঘুরে এসে নেশন পত্রিকায় লিখেছেন, এখানে কবর দেওয়ার জায়গা পর্যন্ত নেই। এই গ্রামে কয়েক বছর আগেও ২৩৯টি পরিবারের বসতি ছিল। এখন তাদের সংখ্যা কমে ৩৮-এ দাঁড়িয়েছে। প্লাবন যদি স্থায়ী ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, তখন ঘরবাড়ি হারিয়ে এখানকার মানুষ যাবে কোথায়? কী খাবে?
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মতো দেশের সমস্যা নিয়ে এখন মস্ত সব গবেষণাপত্র লেখা হচ্ছে, পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন। ভিন্ন মতাবলম্বী যে নেই তা নয়, কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ পরিবেশবিজ্ঞানী এ ব্যাপারে একমত যে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা বাস্তব সত্য, কোনো কল্পকাহিনী নয়। পরিবেশে কার্বন গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মেরু অঞ্চলের জমাট বাঁধা বরফ গলতে শুরু করেছে। এর ফলে একদিকে সমুদ্রপিঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশগত বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। তাপমাত্রার এই বৃদ্ধি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে সমুদ্র-নিকটবর্তী নিচু অঞ্চল ভেসে যেতে বাধ্য। বিজ্ঞানীরা আগামী এক শতকের ভেতর যে পরিবর্তন হবে, তার তিনটি সম্ভাব্য চিত্র বা সিনারিওর কথা বলেছেন। পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, তাহলে সমুদ্রপিঠ .২৩ মিটার বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু তাপমাত্রা যদি ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায়, তাহলে সমুদ্রপিঠ ০.৫২ মিটার বেড়ে যাবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আমাদের চলতি জীবনযাত্রা যদি অপরিবর্তিত থাকে, জ্বালানি তেলের কোনো বিকল্প ব্যবহার আমরা উদ্ভাবনে ব্যর্থ হই, তাহলে পৃথিবীর ভুভাগের তাপমাত্রা আরও মারাত্মক পরিমাণে বেড়ে যেতে পারে। যদি এই তাপমাত্রা ৫.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায়, তাহলে আগামী ১০০ বছরে সমুদ্রপিঠ দুই মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। যদি প্রথম চিত্রটি বাস্তবে পরিণত হয়, তাহলেও বাংলাদেশের ১০০০ বর্গকিলোমিটার কৃষিজমি বিনষ্ট হবে এবং প্রায় এক কোটি মানুষ বসতবাটি হারাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুধু যে বসতবাটি তলিয়ে যাবে তাই নয়, তলিয়ে যাবে আবাদি জমি, মাছের খামার। আমরা হারাব বনাঞ্চল, হারাব মূল্যবান প্রবাল-প্রাচীর বা কোরাল রিফ। পরিবেশের ভারসাম্য বদলের ফলে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাবে, বর্ষাকাল হ্রস্ব হবে, গ্রীষ্ক্নকাল দীর্ঘ হবে। ফলে মরুপ্রবণতা বাড়বে, পদ্মা ও ব্রਜ਼পুত্র শুকিয়ে মৌসুমি নদীতে পরিণত হবে। এ ছাড়া সুপেয় পানির সংকট চুড়ান্ত আকার ধারণ করবে, নানা রকম রোগশোক মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়বে এবং শিশুমৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
সমুদ্রসীমা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে প্লাবনের যে সমস্যা তাতে কেবল বাংলাদেশ নয়, সমুদ্র উপকুলবর্তী অধিকাংশ দেশই আক্রান্ত হবে। যুক্তরাজ্য, হল্যান্ড বা আমেরিকার লুইজিয়ানাও তলিয়ে যেতে পারে যদি কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হয়। ব্যবস্থা নেওয়া মানে সমুদ্র শাসন, বানের জল আটকানোর জন্য বাঁধ নির্মাণ। এর জন্য দেদার পয়সা লাগে, হল্যান্ড বা আমেরিকার সে পয়সা আছে। যুক্তরাজ্য ও হল্যান্ড বছরে এই খাতে নিজ নিজ দেশের জন্য এক একশ কোটি ডলার খরচের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের অত পয়সা কোথায়?
আবহাওয়ামন্ডলের উষ্ণতা বাড়ার যে সমস্যা, তার সৃষ্টির পেছনে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কার্যত কোনো ভুমিকাই নেই। যে ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’কে উষ্ণতা সৃষ্টির জন্য দায়ী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, বাংলাদেশে তার ব্যবহার বিশ্বের মোট ব্যবহারের ০.১ শতাংশেরও কম। অন্যদিকে আমেরিকা একাই দায়ী এর প্রায় এক-তৃতীয়াংশের জন্য। যদি শুধু কার্বন-ডাইঅক্সাইডের কথা ধরি, তাহলে একজন আমেরিকান এই গ্যাস যে পরিমাণ ব্যবহার করে, তা ১০৭ জন বাংলাদেশির ব্যবহারের সমান। শুধু আমেরিকা কেন, পশ্চিমা বিশ্বের সব দেশই জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করেই তাদের অর্থনীতি এ পর্যায়ে এনেছে। আমরা যখন সবেমাত্র শিল্পোন্নতির পথে আগুয়ান হচ্ছি, তখনই জানানো হলো, এই পথে চললে সবার আগে ডুবব আমরাই। উন্নত দেশগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তবে সে ক্ষতি সামলানোর জন্য যে অর্থ ও প্রযুক্তি দরকার, সেটা তাদের আছে। অন্যদিকে আমরা কেবল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তই নই, সে বিপদ সামলানোর মতো বিত্তও আমাদের নেই। তৃতীয় বিশ্বের কোনো কোনো দেশ তাই যুক্তি দেখাচ্ছে, যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী পশ্চিমা বিশ্ব, তার ফলাফলের দায়ভারও তাদেরই বহন করতে হবে। একদিকে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে এই বিপর্যয় মোকাবিলায় অর্থ ও প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করতে হবে।
আমরা দাবি করলাম আর আমেরিকা-জার্মানি-জাপান তাদের চেক বই নিয়ে লিখতে বসে গেল, এমন কথা ভাবা বাতুলতা। আমেরিকার বুশ প্রশাসন এখন পর্যন্ত ভুমন্ডলের উষ্ণতার বিষয়টি মানতে পর্যন্ত রাজি নয়। কার্বন গ্যাস নিয়ন্ত্রণের যে মাত্রা বেঁধে দেওয়ার কথা জাতিসংঘ বলে আসছে, তা মানতেও সে রাজি নয়। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কার্বন গ্যাস নিয়ন্ত্রণের যে চুক্তি হয়েছে তাতে উন্নয়নশীল দেশসমূহকে সাহায্যের জন্য একটি তহবিল সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে বটে, তবে তাতে চাঁদা পড়েছে খুবই সামান্য।

তাহলে পথ কী?
আমরা জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রধান প্রতিক্রিয়া হবে মানবগোষ্ঠীর স্থানান্তর। প্লাবিত অঞ্চলের মানুষ বসতবাটি ছেড়ে আশ্রয়ের সন্ধানে পথে নামবে। কিন্তু কোথায় যাবে তারা? আফসানের তথ্যচিত্রে এই প্রশ্নের একটি সোজাসাপটা উত্তর রয়েছে: এই ‘পরিবেশ-উদ্বাস্তু’রা নিজের দেশে জায়গা না পেলে পা বাড়াবে প্রতিবেশী দেশে অর্থাৎ ভারতে। এমন ঘটনা শুধু এই অঞ্চলে নয়, প্লাবন-আক্রান্ত সব দেশেই ঘটবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী ৫০ বছরে কম করে হলেও ১০০ কোটি মানুষ নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজে নিতে বাধ্য হবে। দারিদ্র্য, মরুকরণপ্রবণতা ও প্লাবণের কারণে দরিদ্র দেশগুলোর মানুষ বরাবরই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আশ্রয় খোঁজে। কিন্তু ‘পরিবেশ উদ্বাস্তু’দের সংখ্যা আগের যেকোনো বহির্গমনকে ছাড়িয়ে যাবে। এর ফলে লাখ লাখ মানুষ শুধু যে প্রচন্ড দুর্ভোগ ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে পড়বে তাই নয়, পাশাপাশি অবস্িথত এক দেশ আরেক দেশের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহেও লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উদ্বাস্তু সমস্যার কারণে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অসদ্ভাব অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করবে, তার সংখ্যা আগের যেকোনো সংখ্যার চেয়ে বেশি হবে, অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই সে ব্যাপারে একমত। তাই যদি হয়, তাহলে এই দুই দেশ সে সমস্যার মোকাবিলা করবে কীভাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি না। কিন্তু এ কথা জানি, পরিবেশগত কারণে যে সমস্যা ও সংকট দেখা দেবে, তার মোকাবিলা একা এদের কারও পক্ষে করা সম্ভব হবে না। যা করার দুজনে বা দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশ মিলে একযোগে করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার জনবহুল দেশগুলো, যারা প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তারা নিজেদের সমস্যা মোকাবিলায় একটি সাধারণ প্লাটফর্ম বা আলোচনাক্ষেত্র ইতিমধ্যে গড়ে তুলেছে। সেই প্লাটফর্মের নাম সার্ক। এত দিন এই আলোচনাক্ষেত্রটি কার্যত অব্যবহূত থেকে গেছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে আমাদের সবার মাথা এক করে যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের। সময় এসেছে সার্ক থেকে ‘সার্ক প্লাস’ গঠনের।
‘সার্ক প্লাস’ বলতে আমি কী বোঝাচ্ছি, সে কথা আগে বলি। ১৯৮৫ সালে সার্কের ধারণাটি যখন গৃহীত হয়, সে সময় এর সদস্যরা প্রধানত অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রসমূহে পারস্পরিক সহযোগিতার কথাই ভেবেছিল। কিন্তু ‘সার্ক প্লাস’ হবে গুণগতভাবে ভিন্ন, এর লক্ষ্য হবে সহযোগিতা নয়, সমন্বয় ও একীকরণ (ইন্টিগ্রেশন)। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো একই ভুখন্ডের অন্তর্গত, তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈপরীত্যের চেয়ে নৈকট্যই বেশি। তাদের সবার অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাত্রা অবশ্য এক নয়; যার যার অর্থনৈতিক সম্পদ ও তার ব্যবহারের সম্ভাবনাও এক রকম বা একই পর্যায়ে নয়। কেউ এক ক্ষেত্রে এগিয়ে, কেউ পিছিয়ে। কিন্তু সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের সম্পদের ব্যবহার করা গেলে এক দেশ নয়, সব দেশই লাভবান হবে। উদাহরণ হিসেবে শুধু পানি সম্পদের সমন্বিত ব্যবহারের কথা ভাবুন। হিমালয় অববাহিকায় যে পানি সম্পদ রয়েছে তার পুরোপুরি ব্যবহার সম্ভব, যদি এই অঞ্চলের দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে শুধু সহযোগিতা নয়, সমন্বয়মূলক অর্থনীতি গড়ে তোলে। এক হিসাবে দেখছি, এই পানি সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে ৮৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এখন আমরা তার ক্ষুদ্রাংশ উৎপাদন করে থাকি। একইভাবে একে অপরের স্থল পরিবহন সুযোগ সম্প্রসারণ করে পারস্পরিক বাণিজ্যের বিপুল প্রসার ঘটানোও সম্ভব।
পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের দেশগুলো এই সমন্বয়ের বিবেচনা থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন গড়ে তুলেছে। তারা কেবল অর্থনীতি নয়, নাগরিক জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই একীকরণের উদ্যাগ নিয়েছে। নতুন যে সমন্বয় কাঠামো দ্বারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিচালিত, তার কেন্দ্রে রয়েছে পণ্য, পুঁজি, শ্রমিক ও সাধারণ নাগরিক− এই চার ধরনের অবাধ যাতায়াত বা ফ্রি মুভমেন্ট। সীমানাচিহ্ন এখনো আছে তা ঠিক, কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিটি দেশের নাগরিক, তাদের পুঁজি বা পণ্য বিনা বাধায় সে চিহ্ন অতিক্রম করে এক অপরের দেশে যেতে পারে।
সার্কই যেখানে সফল হয়নি, সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধাঁচের সার্ক প্লাস গঠন খুব সহজ হবে না, তা বলাই বাহুল্য। সার্ক গঠনের পেছনে সহযোগিতা ও সমন্বয়ের বদলে রাজনৈতিক বিবেচনাই বেশি কাজ করেছে। যার যার রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থে বিন্দুমাত্র চোট লাগে এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে অঞ্চলের দেশগুলো কেউই রাজি হয়নি। তা ছাড়া আমাদের নেতাদের কাছে নাগরিক কল্যাণের বদলে নিরাপত্তার প্রশ্নটি বরাবরই অগ্রাধিকার পেয়েছে। আমরা জানি, বাণিজ্য ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠতর সহযোগিতা, এমনকি সমন্বয়ের কথা বলে ১৯৯৫ সালে ‘সাপটা’ চুক্তি এবং ২০০৪ সালে ‘সাফটা’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ছাড় দিতে রাজি না হওয়ায় এ চুক্তির কোনোটাই খুব একটা এগোয়নি। কেন এগোয়নি, তার একটি সুচিন্তিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভারতীয় কুটনীতিক মুচকুন্দ দুবে। গত বছর এপ্রিলে ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকায় এক প্রবন্ধে দুবে জানান, বিভিন্ন সময় খুব শোরগোল তুলে নানা প্রস্তাব সার্ক নেতারা নিয়েছেন, কিন্তু সেসব বাস্তবায়নের জন্য যে অংশীদারত্বের দুরদৃষ্টি বা শেয়ারড ভিশন প্রয়োজন, তা তাঁদের ছিল না। যাঁর যাঁর নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ মাথায় রেখে তাঁরা নিজেরাই সেসব প্রস্তাবের মৃত্যু ত্বরান্বিত করেছেন: ‘সার্ক প্রক্রিয়া কার্যত একে অপরকে ঠকানোর এক প্রেিতযাগিতা ছাড়া আর কিছু নয়।’
এখন জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট যখন আমাদের ওপর ক্রমান্বয়ে বোঝা হয়ে নেমে আসছে, অস্তিত্ব রক্ষার কারণেই আমাদের একীকরণ ও সমন্বয়ের কথা ভাবতে হবে। আমরা ডুবে গেলে পৃথিবীর কারও কিছু হয়তো এসে যায় না, কিন্তু আমাদের নিজেদের কিছু এসে যায় বৈকি! আমাদের বোঝা আমাদেরই বইতে হবে, অন্য কেউ তা বয়ে দেবে না।

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments: