Thursday, June 19, 2008

ধ্যান: সফলতা অর্জনের গোপন অস্ত্র

মুল ‌খবর: প্রথম আলোর, স্বাস্থ্য কুশল (১৮ জুন, ২০০৮)

সফলতা অর্জনের গোপন অস্ত্র

অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর
কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা

ঘটনাটি ঘটেছিল আমেরিকায়। ওয়াল স্ট্রিটে। অনেক শ্রোতার উদগ্র আগ্রহে অপেক্ষা। ২০০ জন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এর মধ্যে এয়ারলাইন ও তেল কোম্পানিরাও আছে।
এনার্জির বাজার খুব নড়বড়ে−এই উঠছে, এই নামছে।
ভদ্রলোকের নাম ওয়ালটার জিমারম্যান, ৫৪ যাঁর বয়স−এই কৃতী পারফরমারের জন্য অপেক্ষা। ডজন ডজন স্ক্রিন ও গ্রাফিক্সে ভেসে উঠল তাঁর মুখ−প্রশান্ত চেহারা।

তুখোড় জিমারম্যান, প্রখর বুদ্ধি ধরেন। ধারাল এই বুদ্ধির পেছনে কী রহস্য?

ধ্যানচর্চা। তিনি প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে ৪০ মিনিট ধ্যান করেন। তিনি জানান, এই চর্চা তাঁকে দ্রুত অথচ অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন বিশ্লেষণ করার জন্য মনের যে স্বচ্ছতা-স্পষ্টতা প্রয়োজন হয়− তা বজায় রাখতে এমনকি সৌভাগ্যের মুহুর্তে পৌঁছাতে সহায়তা করে। তিনি বলেন, ‘ধ্যান হচ্ছে সেই গোপন হাতিয়ার।’
আমরা মোটামুটি জানি যে ধ্যানচর্চা মানসিক চাপ হ্রাস করে। তবে মগজকে স্ক্যানিং করার উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে, গবেষকেরা দেখাতে সমর্থ হচ্ছেন যে ধ্যান সরাসরি প্রভাব ফেলে মগজের গঠন ও কাজকর্মের ওপর, এমন এক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব যাতে মনোযোগ বা অভিনিবেশ করার বিস্তৃতি বাড়ে, ফোকাসকে তীক্ষੲ করে এবং স্নৃতিশক্তিকে উন্নত করে।

সাম্প্রতিক এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, প্রতিদিন ধ্যানচর্চা মগজের সেরেব্র্যাল কর্টেক্সের সেসব অংশকে পুরু করে যে অংশ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, মনোযোগ ও স্নৃতিশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে। ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের একজন গবেষণা-বিজ্ঞানী সারা ল্যাজার গত নভেম্বরে প্রাথমিক কাজকর্মের যে ফলাফল প্রকাশ করেছেন এতে দেখা যায়, ২০ জন নারী-পুরুষ যারা দিনে ৪০ মিনিট ধ্যানচর্চা করেছে, এদের মগজের ধুসর পদার্থ−যারা ধ্যান করেনি, এদের তুলনায় অনেক পুরু। আগের যে গবেষণাগুলো হয়েছে, সেগুলো করা হয়েছিল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের ওপর।

এবার যাদের ওপর গবেষণা চলেছিল, এরা ছিল বোস্টন এলাকার শ্রমিককর্মী, যারা পশ্চিমা ধাঁচের ধ্যানচর্চা করেছিল−এর নাম হলো দমাইন্ডফুলনেস অথবা ইনসাইট মেডিটেশন’।
ল্যাজার বলছেন, ‘প্রথমবারের মতো আমরা দেখলাম যে অনুরূপ ফলাফল লাভের জন্য আমাদের সারা দিনই তা করতে হবে, তা নয়।’ এ ছাড়া তাঁর গবেষণা থেকে আরও জানা গেছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গুরু মস্তিষ্কেকর যে অংশ স্বাভাবিক নিয়মেই পাতলা হয়ে যায়, একে ধীরে করে দিতে পারে ধ্যানচর্চা।
ল্যাজার ও অন্য বিজ্ঞানীরা যে ধরনের ধ্যানচর্চা নিয়ে গবেষণা করছেন, সেগুলো হলো কোনো প্রতিচ্ছবি বা শব্দ বা একজনের শ্বাসক্রিয়াকে লক্ষ করে, এর প্রতি মনকে নিবদ্ধ রেখে ধ্যান। সহজ করে বলা যায়, এ চর্চাটি মগজের সেসব অংশের ব্যায়াম করায়, যেসব অংশ মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ করে।

উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাবরেটরি ফর এফেকটিভ নিউরোসায়েন্সের ডিরেক্টর রিচার্ড ডেভিডসন বলেন, ‘শিক্ষার মূল চাবিকাঠি হলো মনোযোগ, এবং ধ্যানচর্চা দ্বারা একে ইচ্ছানুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’
১৯৯২ সাল থেকে দালাইলামার সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তিনি তিব্বতের সন্ন্যাসীদের মগজ নিয়ে গবেষণা করে আসছিলেন। এসব সন্ন্যাসীকে তিনি বলতেন, ‘দ্য অলিম্পিক অ্যাথলেটস অব মেডিটেশন’।

সন্ন্যাসীদের মাথার ওপর ইলেকট্রিক সেন্সরসহ ক্যাপ লাগিয়ে ডেভিডসন প্রচন্ড শক্তিশালী গামা রশ্মি তুলে নিয়েছিলেন যেগুলো অন্যদের চেয়ে তিব্বতের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে অনেক ভালো সামজ্ঞস্য করে চলছিল। এ গামা তরঙ্গের সমকালীনতা সজাগ সতর্ক অবস্থায় বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অনেকে, যারা ধ্যানাভ্যাস করে, এরা দাবি করে যে এই চর্চায় এনার্জি পুনঃস্থাপিত হয়। যেসব কাজ করতে অভিনিবেশ ও মন-সংযোগ প্রয়োজন, সেসব কর্ম সম্পাদনে ভালো পারফর্ম করার সুযোগ দেয় ধ্যানাভ্যাস। তাহলে মধ্যাহ্নে দিবানিদ্রা কি একই ফল দেয়? কেন্টাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজির সহযোগী অধ্যাপক ব্রুস ওহারা বলেন, ‘না’। এ বিষয়ে তিনি গবেষণাও করেছেন, কিছু কলেজছাত্রছাত্রীর ওপর গবেষণা করা হয়েছে; এদের মধ্যে কেউ ধ্যান করেছে, কেউ ঘুমিয়েছে, কেউ কেউ টিভি দেখেছে। এরপর তিনি এদের ‘সাইকোমটোর ভিজিল্যান্স’ টেস্ট করেছেন। একটি আলো স্ক্রিনে ঝলকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি বোতাম টিপতে বললেন তাদের। যাদের ধ্যান করতে শেখানো হয়েছে−এদের পারফরম্যান্স ছিল ১০ শতাংশ বেশি ভালো। যারা ঘুমিয়েছিল এদের পারফরম্যান্স হলো নিকৃষ্ট। এতে কী বোঝা গেল? ওহারার ব্যাখ্যা হলো, ‘ধ্যানচর্চা স্মায়ুসন্ধিকে পুনঃস্থাপিত করে ঘুমের মতোই, তবে সুচনাকালে এর মধ্যে টলমল ভাব থাকে না।’

এসব ফলাফল অনেক বড় বাণিজ্য সংস্থা অনুধাবন করেছে, বড় বড় ব্যাংক, এয়ারক্রাফট কোম্পানি তাদের কর্মীদের জন্য ধ্যানচর্চার ক্লাস চালু করেছে। কর্মচারীরা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন হয়, প্রখর হয়, উৎপাদনশীলতা বাড়ে, চাপজনিত অসুখ কমে, অনুপস্থিতি কমে। বাড়ে আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। `Emotional Intelligence" একে নির্মাণ করা ধ্যানচর্চার বড় অবদান। জীবনে সফলতার জন্য এর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

No comments: