Friday, December 26, 2008

বীরাঙ্গনাদের মানবেতর জীবন: অপেক্ষা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের

প্রকাশ: সাপ্তাহিক, (সাপ্তাহিক পত্রিকা), ২৫ ডিসেম্বর ২০০৮, বর্ষ ১ সংখ্যা ৩২

বীরাঙ্গনাদের মানবেতর জীবন অপেক্ষা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের




১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশকে শত্রু মুক্ত করে স্বাধীন করবেন বলে। জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। গ্রামে শহরে পাকিস্তানি মিলিটারিরা মানুষ খুন করছে, ধর্ষণ করছে; জ্বালিয়ে দিচ্ছে ঘরবাড়ি। পাকিস্তানি এই জল্লাদদের সঙ্গে করে বাড়ি বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে বাঙালি রাজাকার আল বদর। এই রাজাকার আল বদররা শুধু মানুষ হত্যা কিংবা ঘরবাড়ি জ্বালানোর কাজেই পাকিস্তানি বর্বর জল্লাদদের সহায়তা দেয়নি। মেয়েদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তানি মিলিটারিদের উপঢৌকন হিসাবে।

স্বাধীনতা যুদ্ধ একদিন শেষ হয়েছে। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছে স্বাধীন দেশ হিসাবে। ’৭১-এর পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে নির্যাতিত এসব নারীকে ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দিয়েছেন। ‘নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র’ নামে কেন্দ্রে বীরাঙ্গনাদেরকে পুনর্বাসন করে বঙ্গবন্ধু সরকার। এই কেন্দ্রের মূল সংগঠক ছিলেন ড. নীলিমা ইব্রাহীম। অন্যান্য জেলার মতো সিরাজগঞ্জেও নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র চালু হয়। কাজ শুরু করেন সখিনা হোসেন ও সাফিনা লোহানী। বিভিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ করে ৩০ জন বীরাঙ্গনাকে বের করেন এই দুই নারী। ১৯৭৩ সালে সিরাজগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ভাষণে এই ৩০ জন বীরাঙ্গনাকে সঙ্গে নিয়ে এক মঞ্চে ভাষণ দিলেন। বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনাদেরকে মা বলে অভিহিত করলেন। সেদিনকার সেই স্মৃতি ছাড়া বীরাঙ্গনাদের ঝুলিতে আনন্দের-সুখের ও সম্মানের কোনো স্মৃতি নেই। এর পর ১৯৭৫ সাল। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। বন্ধ করে দেয়া হলো পুনর্বাসন কেন্দ্রটি। সমাজে বীরাঙ্গনারা চরম অবহেলা আর ঘৃণার পাত্র হিসাবে বিবেচিত হতে থাকলেন। এ রকম সময় এগিয়ে আসেন নারী সংগঠক সাফিনা লোহানী। তৈরি করেন উত্তরণ নামে একটি বেসরকারি সেবা সংস্থা। ফান্ডের অপ্রতুলতা আর বৈরী পরিবেশে কাজ করে যাচ্ছে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে উত্তরণ। ৩০ বীরাঙ্গনার মধ্যে ইতোমধ্যে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পরে সকলের যেমন জানাজা বা দাহ হয়। এ সব বীরাঙ্গনাদের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। তাদের জানাজায় কেউ আসেনি। ক্ষমতাবানেরা এদেরকে দেখে অচ্ছুত হিসেবে, খারাপ মানুষ হিসেবে। সিভিল সোসাইটি, শিক্ষিতরা তাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান আখ্যা দেয়। অথচ এই শ্রেষ্ঠ সন্তানরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তি হননি সিরাজগঞ্জে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও তাই পান না এ বীরাঙ্গনারা। বৃদ্ধ ভাতা, ভিজিএফ কার্ড কোনোটাই তাদের কপালে জোটেনি। এদের ভাগ্যে তাই জুটেছে অন্যের বাড়িতে আশ্রয়। গরু-ছাগলের পাশে কোনোমতে জড়োসড়ো হয়ে রাত কাটান এসব বীরাঙ্গনা। এদের মধ্যে হাসনা বানু মারা গেছেন গত বছরে। জানাজায় অংশ নেয়নি কেউ। মৃত্যুর আগে যার সঙ্গে দেখা হতো তাকেই বলতেন, আল্লায় আমাকে রাজাকারদের বিচার দেখাল না। এসব ক্ষত নিয়ে অর্ধমৃত হয়ে বেঁচে আছেন বীরাঙ্গনারা। যারা বলে দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধ হয়নি, তাদের সম্পর্কে বীরাঙ্গনা রাহেলা আমাদের বলেছেন, আমাদের নিয়ে যাইয়েন আমরা বলব, কারা রাজকার আছিল, আমরা বলব।’ রাষ্ট্র এদের কথা শুনবে কিনা জানি না, তবে সাধারণ বাঙালি হিসেবে আমরা চাই এই নির্মম নির্যাতনের বিচার হোক। সিরাজগঞ্জ ঘুরে এসে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে ­লিখেছেন মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান



মাহেলা

সরকারি জায়গায় তোলা ঝুপড়িতে থাকেন এই বীরাঙ্গনা। বস্তিঘরটিও দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের। এই পৃথিবীতে নিজের বলে কিছু নিই। অভাব আর অভাব গ্রাস করেছে। অভাবের সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের হুমকি ধমকি। কোনোভাবেই যেন মিডিয়ার কাছে মুখ খুলবে না। এই বীরাঙ্গনা ‘সাপ্তাহিক’কে জানিয়েছেন, যারা আমাদের সাংবাদিকদের কাছে কথা বলতে মানা করে তারা অনেক শক্তিশালী। তাদের অনেক টাকা। তারা এখানকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে।

করিমন

করিমনের সিরাজগঞ্জের কান্দাপাড়ায় বিড়ি শ্রমিক খোরশেদের সঙ্গে বিয়ে হয় আজ থকে প্রায় ৪০ বছর আগে। দু’বছরের মাথায় কোলজুড়ে আসে একটি ছেলে সন্তান। এর পরই আসে ভয়াল মার্চ। শুরু হয় স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ। আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে করিমন নামে এই বৃদ্ধার চোখ কেঁপে উঠল। ১৯৭১ থেকে ২০০৮, দীর্ঘ সময়। তার পরও কোনো এক ভয়, দ্বিধা সঙ্কোচ এই বৃদ্ধাকে থামিয়ে দিচ্ছে। এক সময় শান্ত হলেন, বলা শুরু করলেন। মাসের নাম মনে নেই। তবে ঘটনাটির বর্ণনা দিলেন।

করিমন রুটি বানাচ্ছিলেন। চুলোর তাওয়ায় রুটি হচ্ছে। এ রকম সময় মানুষের দৌড়া দৌড়ি, চিৎকার। আর একটি শব্দ ঘুরে ফিরে আসছে, গ্রামে ‘মিলিটারি’ আইছে। করিমন তাওয়ায় রুটি রেখে দৌড়ে ঘরে যাবার আগেই পাকিস্তানি মিলিটারি তার উঠানে এসে হাজির হয়। করিমন ঘর বন্ধ করতে পারে না। তার আগেই পাকিস্তানি হায়েনাদের দল ঢুকে যায় তার ঘরে। একমাত্র সন্তান তখন পযর্ন্ত করিমন বুকে আগলে রেখেছেন। মিলিটারি সেই বুকের ধন সন্তানটিকে বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দূরে ছুড়ে দেয়। এরপর...। তার আর পর নেই। বাংলা সিনেমার দৃশ্য। করিমন বলতে পারেন না। চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ে। করিমনের বাড়ি থেকে যমুনা অল্প একটু দূরে। তবুও করিমনের এই জল যেন যমুনাকে হার মানায়। ধাতস্থ হতে কিছু সময় নেন। আবার আলাপ শুরু হয়। ওরা চলে যাবার পর করিমনের জ্ঞান যখন ফিরল, তখন তিনি জানতে পারলেন তার সন্তানটি মারা গেছে। সন্তানের শোক কাটানোর আগেই করিমনের স্বামী খোকশেদ শোনাল আরেক শোকবাণী। এই স্ত্রীর সঙ্গে সে আর ঘর করবে না। গ্রামের মানুষ অনেক বুঝায় করিমনের স্বামীকে যে এটা করিমনের অপরাধ নয়। অপরাধ যা সেটা তো পাকিস্তানি মিলিটারির। খোকশেদ করিমনকে ঘরে তুলে নিলেও, ঐ রাতেই তিনি হার্ট এ্যাটাকে মারা গেলেন। সেই থেকে শ্যাওলার মতো ভাসছেন।

যমুনার তীব্র স্রোত যে করিমন বুকে ধারণ করে আছেন, তা বোঝা গেল তার শেষ বক্তব্যে। না খেয়ে তবুও কেমন করে যেন বেঁচে আছি। বেঁচে আছি রাজাকারদের বিচার দেখার জন্য।



জয়গুন

সিরাজগঞ্জের তেঁতুলিয়া গ্রামের মেয়ে জয়গুন। উঠতি বয়সী জয়গুনের গ্রামের প্রত্যেক বাড়িঘর চেনা। মাঠের পর মাঠ দৌড়ে বেড়ান। বাবা মা না থাকায় এতিম এই বালিকার একমাত্র সহায় ছিলেন বড় ভাই। মাঝে মাঝে ভাইকে খাবার দিতে মাঠেও যেতেন জয়গুন। এরকমই একটি দিন। জয়গুন ভাইকে মাঠে খাবার দেয়ার জন্য যাচ্ছেন। এ রকম সময় মিলিটারিরা গ্রামে আসে। জয়গুন ভাইয়ের কাছে পৌঁছে গেছেন। চারদিকে ভয়ার্ত মানুষের চিৎকার। এরপর পাশের বেতঝাড়ে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালায় পালাক্রমে পাকিস্তানি আর্মিরা। বোনের এই সম্ভ্রমহানি ভাই নিজ চোখে দেখেন। অসহায় ভাইয়ের কিছুই করার ছিল না সশস্ত্র সেনাবাহিনীর সামনে। এক সময় শেষ হয় পশুদের অত্যাচার।

অভিমানী ভাই বোনের এই পরিণতি সহ্য করতে পারে না। ঘুমের মধ্যে প্রায় চিৎকার করে উঠতেন। অল্প কিছুদিন পর ভাইটিও মারা গেলেন। একদম একা হয়ে গেলেন জয়গুন। গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে বিয়ে দিলেন পাশের গ্রামে। এ ঘরে তার চারটি সন্তান হয়। ছেলে সন্তানগুলো একে একে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। শুধু রয়েছে একমাত্র মেয়েটি। মেয়েটি বিয়ের উপযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও অর্থের অভাবে বিয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। মেয়েটি শীতল পাটি তৈরি করে, আর জয়গুন পরের বাসায় ঝিয়ের কাজ করে কোনোভাবে দিন যাওয়া না যাওয়ার মাঝে আছেন।

পঞ্চাশোর্ধ এই বৃদ্ধাকে দেখতে আসেননি রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা। তবুও তিনি ক্ষোভটা রাষ্ট্রের প্রতিই ঝাড়লেন। বিচার চান এই পাশবিক নির্যাতনের।

’৭১-এর সেই গ্রাম এখনো ছেড়ে যেতে পারেননি জয়গুন। বীরাঙ্গনার উপাধি গ্রামের মানুষ তাদের সঙ্গে কথা বলে না। খারাপ চোখে দেখে, ঘৃণা করে।



জোসনা

বাঘবাটি গ্রামের বৌ জোসনা। স্বামী গরুর গাড়ি চালান। এ রকম সময় এলো ১৯৭১। ভয়াল মার্চের পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল গ্রামে মিলিটারি আসবে। ছেলে বুড়ো সবাই আতঙ্কে থাকে। জোসনার স্বামীর গরুর গাড়ি চড়েই একদিন গ্রামে এলো পাকিস্তানি মিলিটারি। দুটো গরুর একটি গরু মিলিটারিরা জবাই করে খেল। তারপরও শান্তি যে গ্রামে তারা এখনো আগুন দেয়নি, হত্যা করেনি। খাওয়া দাওয়ার পরেই শুরু হয়ে যায় বাড়ি বাড়ি আগুন দেয়া। পাশের বাড়িতে কয়েকদিন আগে এক সন্তান প্রসব করেছে যে মেয়েটি তার কোল থেকে দুধের শিশু বাচ্চাটিকে ফেলে দিল গাছের ওপর। বাচ্চাটি হয়ত কান্নারও সুযোগ পায়নি। তার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে জোসনা পাশের ধানক্ষেতে লুকায়। আর ধান ক্ষেত থেকে জোসনা প্রত্যক্ষ করেন সদ্য প্রসব করা মেয়েটিকে কীভাবে মিলিটারি পশুর দল কুকুরের মতো খাবলে খাচ্ছে। মেয়েটি ওখানেই মারা যায়। জোসনার বুকের ভেতর থেকে পাথর সরে যায়। বিপদ বুঝি কেটে গেল। ধানক্ষেত থেকে বের হবার সময় ধরা পড়ে যায় একদল বাঙালি রাজাকারের হাতে। তারাই জোসনাকে তুলে দেয় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। তারপর... । পাঠক আমরা আর আগাতে পারিনি। এরপর শুধু জোসনার চোখ দিয়ে গড়িয়েছে অঝোর ধারায় জল। সেই অপমান, ঘৃণা বুকে পুশে নিয়ে জোসনা আজো বেঁচে আছেন। আমরা যখন তার খুপড়ি ঘর থেকে মাথা নিচু করে বের হয়ে আসছিলাম, তখন এই বীরাঙ্গনা একটা কথাই বললেন, ‘আমি এই পাপের বিচার চাই।’ আমরা তাকে এই সান্ত্বনা দিয়ে আসতে পারলাম না রাজনীতিবদিদের মতো, এই ভয়াল নির্যাতনের বিচার হবে।



রাহেলা

রাহেলা বিবাহিতা। বগুড়া থেকে পাকিস্তানি আর্মির একটা গাড়ি সিরাজগঞ্জে এসে পৌঁছায়। পাকিস্তানি আর্মির চতুর্দিকে ধ্বংস আর আগুনের ভয় থেকে পালাতে গিয়ে পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক অবরুদ্ধ হয় বেলগাতি গ্রামে। এক হিন্দু বাড়িতে আশ্রয় নেয় রাহেলা ও তার স্বামী। লুকানো অবস্থায় রাহেলা দেখতে পায় দুই যুবককে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানি বাহিনী। সেই ভয়াল ঘটনার পরে এসে রাহেলা বলতে পারেন না, সেই দুই যুবক বেঁচে আছে না মরে গেছে। বাঙালিরা পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে ঘরে ঘরে ঢুকে আগুন দিচ্ছে আর উল্লাস করছে। রাহেলা যে ঘরে লুকিয়েছিল, তার সঙ্গে অপরিচিত আরও তিনটা মেয়ে একই ঘরে লুকিয়েছিল পাকিস্তানি আর ঘাতক রাজাকার জল্লাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু শেষ রেহাই হয়নি। ঘরে ঢুকে পড়ে জল্লাদের দল। সকলকে পালাক্রমে পাশবিক নির্যাতন করে।

এরপর থেকেই স্বামী ছেড়ে যায় রাহেলাকে। পাঁচ বছর পরে আবার বিয়ে হয় তার। দ্বিতীয় স্বামী মারা গেছে বছর সাতেক আগে। দুই সন্তানের মধ্যে পুত্র সন্তানটি পড়ালেখা শেষ করেছেন স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। তবে বীরাঙ্গনা হবার অপরাধে কোথাও চাকরি হয় না। স্থানীয় কেউ তাকে চাকরি দেয় না। মিডিয়ার কাছে মুখ খোলার কারণে সমাজের কর্তৃত্বশীল অধিপতিরা ধমক দেয় সমাজের সম্মান নষ্ট করার জন্য। তার চেয়ে মুখ বুঝে সব সহ্য করাই ভালো বলে শেখায় এই আধিপত্যকারী শ্রেণী। তবুও রাহেলা মুখ খুলেছেন। বলেছেন, এই নির্মম নির্যাতনের বিচার চান।



নূরজাহান

নূরজাহানের স্বামী রুস্তম আলী। নূরজাহান তখন এক সন্তানের জননী। সিরাজগঞ্জ শহরে পাকিস্তানি মিলিটারি ঘাঁটি গেড়েছে। মিলিটারি প্রায়ই গ্রামগুলোতে যায়, তাদের মর্জি অনুযায়ী চলে রামরাজত্ব। ঘরে ঘরে আতঙ্ক, যুবতী মেয়েদের রক্ষা করাই যেন একটা কঠিন কাজ। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের কোনো এক সময় নূরজাহান বাবা-মায়ের সঙ্গে এক মাত্র সন্তান নিয়ে অন্য কোন জায়গায় পালানোর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন। বেলগাতি নামক জায়গা এলে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যান নূরজাহানরা। জ্ঞানশূন্য মানুষ বাঁচার জন্য চতুর্দিকে দৌড়াচ্ছে। নূরজাহান একটি প্রাইমারি স্কুলের পেছনে যান। কিন্তু জল্লাদের হাত থেকে রক্ষা পাননি নূরজাহান। মুমূর্ষু অবস্থায় নূরজাহানকে উদ্ধার করে বাবা-মা স্কুল ঘরের পেছন থেকে। শুধু নূরজাহানই নন, অনেক হতভাগীর পরিণাম হয়েছিল নূরজাহানের মতো।

তারপর আর কোনো কথা না বলে আঁচল চাপা দিয়ে শুধু কাঁদতে থাকেন নূরজাহান।

স্বাধীনতার ৩৮ বছর পার করে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি ২১ শতকে। চলছে স্বাধীনতাকে ঘিরে নানা জঘন্য ইতিহাস বিকৃতি। কিন্তু এই বীরাঙ্গনা। যিনি সর্বস্ব খুইয়েছেন। তিনি কিন্তু আজো সাহসের সঙ্গে বললেন, রাজাকারদের বিচার চাই।

ছবি : সীমান্ত রোদ্দুর



‘ইনি-ই হলো ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী’

বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিরুদ্দিন
সাবেক শ্রমিক নেতা সিরাজগঞ্জ স্পিনিং মিল

আমি সিরাজগঞ্জ স্পিনিং মিলের শ্রমিক নেতা ছিলাম। মার্চের ক্রাকডাউনের পর এপ্রিলের দিকে সিরাজগঞ্জ থেকেই আমি ধরা পড়ি। সিরাজগঞ্জে আমি তখন সবেমাত্র মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার জন্য কাজ করছি। বেশ কিছু তরুণকে যুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতে পেরেছি। এ রকম সময় সিরাজগঞ্জ শহর থেকেই আমাকে ধরা হয়। সময়টি ছিল এপ্রিল মাস। এতদিন পরে এসে আমি তারিখটা ঠিকমতো বলতে পারছি না। তবে এপ্রিলের মাঝামাঝিই হবে। পাকিস্তানি বাহিনী আমাকে ধরে নিয়ে যায় ওদের টর্চার সেলে। সেখানে আমাকে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়। আমাকে বার বার ঘুরেফিরে একই প্রশ্নই করা হয়, ‘মুক্তিযোদ্ধারা কোথায়, অস্ত্র কোথায়।’ আমি ওদের বললাম আমি কিছু জানি না।

সিরাজগঞ্জ থেকে এরপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় পাবনা। ঠিক কবে নিয়ে যায় দিনক্ষণ আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কারণ টর্চার সেলে সব দিনই আমাদের সমান মনে হতো। শুধু তাই নয়, আমাদের মনে হতো সময় যেন যাচ্ছে না। রাজশাহী টর্চার সেলে ওরা আমাকে অনেকের সঙ্গে রাখে। ঐ সেলে অনেক মানুষ ছিল। আমি কাউকে চিনি নাই। তবে একজনকে শুধু চিনেছিলাম। বর্তমানে কমিউনিস্ট নেতা টিপু বিশ্বাসের ছোট ভাই। কারণ আমি শ্রমিক নেতা থাকার সুবাদে বামপন্থীদের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। প্রতিদিনই পকিস্তানিরা আসত, তাদের সঙ্গে থাকত বাঙালি রাজাকাররা। সবার গায়ে একটা নম্বর থাকত। আমার নম্বর ছিল ২৭। একদিন এক বাঙালিকে দেখে আমি টিপু বিশ্বাসের ছোট ভাইকে বললাম, ‘ইনি কে?’ টিপু বিশ্বাসের ভাই আমাকে বললেন, ‘ইনি-ই হলো ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী।’ তখন তো আমি মতিউর রহমানকে চিনতাম না। ঐ প্রথম তাকে চিনলাম। এরপর ওখান থেকে ছাড়া পেয়ে আবার সিরাজগঞ্জ চলে এলাম। সিরাজগঞ্জ থেকে একের পর এক গেরিলা অপারেশন করেছি। তার মধ্যে ট্রেজারি লুট ছিল অন্যতম। স্বাধীনতার পরে এত বছর চলে গেল রাজাকারদের কোনো বিচার হলো না। এখন আবার তারা বলছে দেশে কোনো স্বাধীনতা যুদ্ধই হয় নি। ওটা ছিল গৃহযুদ্ধ। এই সাহস আমরা মুক্তিযোদ্ধারাই তাদের দিয়েছি।

বৃদ্ধ এই মুক্তিযোদ্ধার নাম নেই জেলা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। নাম নেই তাতে কী। মহিরুদ্দিনকে এলাকার সবাই চেনে একজন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। মহিরুদ্দিনের কণ্ঠে সেই প্রতিধ্বনি, ‘ঐ সব কাগজে আমার নাম নেই বলে আমার কিন্তু কোনো কষ্ট হয় না। বরং ভালোই লাগে। কারণ ঐ সব কাগুজে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকই ভুয়া, এমন কী কিছু রাজাকারের নামও আছে। আমি ঐ লিস্টে নিজের নাম উঠাতে চাই না। তবে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, এখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উল্টা-পাল্টা কথা বলে তাদের ভয়ঙ্কর সাজা হওয়া উচিত।’



‘আমরা ভারতে গিয়ে কিন্তু ট্রেনিং নেইনি। সম্পূর্ণ নিজেদের ক্ষমতায় যুদ্ধ পরিচালনা করছিলাম’

আমিন ইসলাম চৌধুরী
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির লড়াইটা আমাদের এখানে সিরাজগঞ্জে কিন্তু অনেক আগ থেইে শুরু হয়েছিল। সেই ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় সিরাজগঞ্জে মুসলিম লীগের সঙ্গে সরাসরি আমাদের লাঠি বাঁশ দিয়ে মারা মারি করতে হয়েছে। এরপর ১৯৭০ সালের নির্বাচন এলো। নির্বাচনের পর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করায় সমগ্র বাংলাদেশের মতো আমরাও ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। ডামি রাইফেল দিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে ট্রেনিং শুরু করলাম। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতের পর প্রথম আমরা সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ঘাটিনার ব্রিজে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। সেই প্রতিরোধ থেকেই সিরাজগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। তবে সিরাজগঞ্জ শহরকে কিন্তু আমরা রক্ষা করতে পারলাম না। ওরা শহর দখল করে নিল। সিরাজগঞ্জ শহরটা জ্বালিয়ে দিল। আমরা সরাসরি পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করার কৌশল এড়িয়ে গেরিলা কৌশল নিলাম।

অক্টোবরের মধ্যে আমরা সিরাজগঞ্জের অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে আমাদের দলে ভেড়াতে সক্ষম হলাম। আমরা ভারতে গিয়ে কিন্তু ট্রেনিং নেইনি। সম্পূর্ণ নিজেদের ক্ষমতায় যুদ্ধ পরিচালনা করছিলাম।

ভাটপিয়ারি গ্রামে পাক বাহিনীর একটা ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্পটি ছিল এলাকায় জল্লাদখানা হিসাবে পরিচিত। ক্যাম্পটি ১১ সেপ্টেম্বর আক্রমণ করি। উক্ত আক্রমণে ৩৩ জন পাক মিলিটারি ও রাজাকারকে আমরা হত্যা করি। এটা ছিল সিরাজগঞ্জের উল্লেখযোগ্য সফল হামলা। ঐ যুদ্ধ করতে গিয়ে আমার গায়ে গুলি লাগে। ভাটপিয়ারি যুদ্ধে আমরা ব্যাপক পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করি। এর পর ১৪ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জকে মুক্ত ঘোষণা করি শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই। এখানে কোনো মিত্র বাহিনী মুক্ত করেনি।



জীবিত বীরাঙ্গনাদের নাম ও ঠিকানা

আছিয়া
স্বামী : মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান
ঠিকানা : রানীগ্রাম, রেললাইনের ধারে, সিরাজগঞ্জ, বয়স : ৫০ বছর

কমলা বেগম
ঠিকানা : বিন্দুপাড়া (দত্তবাড়ি), সিরাজগঞ্জ

সামিনা বেগম
স্বামী : মোঃ শুকুর আলী, গ্রাম : নদীর কুর -ক্লোজার সংলগ্ন

সুরাইয়া (ধুল্লি)
স্বামী : শামসুল আলম, গ্রাম : পিটিআই স্কুলের সামনে, নদীর কিনারে, সিরাজগঞ্জ

রাজু বালা
স্বামী : মৃত হরিপদ, গ্রাম : ঝাঐল, চানপুর, সিরাজগঞ্জ

আয়মনা
স্বামী : সমসের আলী, গ্রাম : মতিন সাহেবের ঘাট, ওয়াপদার ঢাল, সিরাজগঞ্জ

সূর্য বেগম
স্বামী : মৃত হারান আলী সেখ
ঠিকানা : রহমতগঞ্জ কবরস্থান সংলগ্ন, নতুন ভাঙ্গাবাড়ি, সিরাজগঞ্জ
বয়স : ৫২ বছর

বাহাতন বেগম
স্বামী : মৃত শুকুর আলী
ঠিকানা : রহমতগঞ্জ কবরস্থানের পাশে, নতুন ভাঙ্গাবাড়ি, সিরাজগঞ্জ, বয়স : ৭০ বছর

আয়শা বেগম
স্বামী : কছিমুদ্দীন, ঠিকানা : নতুন ভাঙ্গাবাড়ি (রহমতগঞ্জ কবরস্থানের পাশে), বয়স : ৫০ বছর

রহিমা
স্বামী : মৃত রিয়াজ আলী
ঠিকানা : চক কোবদাসপাড়া, বয়স : ৭২ বছর

No comments: